• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮

বাড়িভাড়া আইন

প্রতিকি ছবি

মতামত

বাড়িভাড়া আইনের কার্যকারিতা চাই

  • প্রকাশিত ১০ এপ্রিল ২০১৮

বর্তমান বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী মালিক ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে বাধ্য। বাড়িওয়ালা ইচ্ছে করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে বাড়ির মালিকের ওপর এই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২১ নম্বর ধারায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালি নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনবোধে লিফটের সুবিধাও দিতে হবে। ওইরূপ সুবিধা প্রদানে বাড়ির মালিক অনীহা প্রকাশ করলে কিংবা বাড়িটি মেরামতের প্রয়োজন হলেও ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১-এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বাড়ির মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ এক মাসের বাড়িভাড়ার অধিক কোনোপ্রকার ভাড়া, জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি গ্রহণ করতে পারবেন না। তা হলে দণ্ডবিধি ২৩ ধারা মোতাবেক তিনি দণ্ডিত হবেন। আপনার পরিশোধকৃত বাড়িভাড়ার রসিদ সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিক বা তার প্রতিনিধি দিতে বাধ্য।

মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে আইনের ১৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না। বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতিও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪-তে স্পষ্ট করা আছে। এটাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরীকে দশটি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে ক্যাটাগরিভিত্তিক সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হওয়ার তারিখ থেকে দুই বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দুই বছর পর মানসম্মত ভাড়ার পরিবর্তন করা যাবে। এই আইনের ৮ ধারা এবং ৯ ধারায় বর্ণিত রয়েছে যে, মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিক বাড়িভাড়া আদায় করলে সে ক্ষেত্রে প্রথমবারের অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে বাড়ির মালিক দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী প্রত্যেক অপরাধের জন্য এক মাসের অতিরিক্ত যে ভাড়া গ্রহণ করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ির মালিক দণ্ডিত হবেন।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়িভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত ওই ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি ১৮(২) ধারা মতে বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। আইনের ১২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বাড়ি ভাড়ার জন্য বা তার নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য কোনো ব্যক্তি তার আসবাবপত্র ক্রয়ের কোনো শর্ত আরোপ করতে পারবেন না। অর্থাৎ কোনো বাড়ির মালিক তার বাড়িভাড়া বাবদ ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র ক্রয় করতে পারবেন না। তদুপরি ভাড়া নবায়ন কিংবা মেয়াদ বৃদ্ধির শর্ত যদি বাড়িভাড়া চুক্তিতে থেকেও থাকে তা সত্ত্বেও ভাড়াটিয়া বাড়িভাড়া নবায়ন না করে, তাহলেও বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র আটক বা ক্রয় করতে পারবেন না।

অনেক বাড়িওয়ালা আছেন, চুক্তিপত্রের মাধ্যমে কোনো কিছু সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াকে অহেতুক ঝামেলাপূর্ণ মনে করেন। ফলে তারা এই বিষয়টিকে এড়িয়ে চলেন। ভাড়াটিয়াও একটি সুন্দর বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার লোভে চুক্তিপত্র সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী হন না। এর ফলে কোনো ঝুটঝামেলা দেখা দিলে তা নিয়ে অহেতুক হয়রানির শিকার হন। অনেক সময় বাড়িওয়ালাও না জেনে-শুনেই ভাড়াটিয়াকে বাড়িভাড়া দিয়ে ফেঁসে যান, যখন তিনি দেখতে পান ওই ভাড়াটিয়া তার বাড়িতে অবৈধ কিংবা বেআইনি কোনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য যে কেউ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-এর আওতায় রেন্ট কোর্টের আশ্রয় নিতে পারেন।

এ আইনের ৭ ধারা মতে, কোনো বাড়িভাড়া মানসন্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া কোনোভাবেই আদায়যোগ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়া বলতে উপযুক্ত ভাড়াকেই বোঝানো হয়েছে। এ ভাড়া বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপসে নির্ধারিত হতে পারে। আবার ঘরভাড়া নিয়ন্ত্রকও এ ভাড়া নির্ধারণ করতে পারেন। ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির একটি রসিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করিয়ে ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন। বাড়ির মালিক ভাড়ার রসিদের একটি চেক মুড়ি সংরক্ষণ করবেন।

বাড়ির মালিক কোনো কারণে কিংবা ভাড়াটিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে ভাড়ার টাকা নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভাড়াটিয়া ডাকযোগে মানি অর্ডার করে পাঠানোর পর বাড়ির মালিক যদি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, তখন ডাক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার এক পক্ষকালের (১৫ দিন) মধ্যে ভাড়াটিয়া ওই টাকা ভাড়া নিয়ন্ত্রকের (আদালত) কাছে জমা দিতে পারবে। এই শর্ত পূরণ হলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। শর্ত পূরণ না হলে ভাড়াটিয়া খেলাপকারী বলে গণ্য হবে এবং উচ্ছেদ থেকে রক্ষা পাবে না। ভাড়াটিয়াকে বাড়ির মালিক ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো অনুপযোগী বা বসবাসের অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারবে না। আশঙ্কামুক্ত অবস্থায় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের জন্য বাড়িটি যে অবস্থায় প্রস্তুত রাখা উচিত তাই বাড়ির মালিক করতে বাধ্য। নতুবা ভাড়াটিয়া বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন করতে পারেন। শুনানিক্রমে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক বাড়ির মালিককে নির্দেশ দেবেন। বাড়ির মালিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রককে জ্ঞাত করিয়ে তিনি নিজে মেরামত করে নিতে পারবেন। তবে খরচ এক বছরের মোট ভাড়ার ছয় ভাগের একভাগের বেশি হবে না।

১৫ ধারা মতে, নিয়ন্ত্রক বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে বাড়িভাড়া এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, যেন এর বার্ষিক পরিমাণ বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত ওই বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫ শতাংশের সমান হয়। বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার দরখাস্তের ভিত্তিতে দুই বছর পর পর নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে পারবেন। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ কিংবা ইচ্ছা করেই উচ্ছেদ করা যায় না। চুক্তিপত্রের অবর্তমানে যদি কোনো ভাড়াটিয়া প্রতি মাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করেন, অথবা ঘরভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা করতে থাকেন, তাহলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ভাড়াটিয়া ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে আদালত তার বিরুদ্ধে উচ্ছেদের আদেশ দিতে পারেন। সাধারণত বাড়িভাড়া আইনের আওতায় যেসব কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যায়, তা হলো :

১. ভাড়াটিয়া সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের আওতায় ১০৮ ধারা পরিপন্থি কাজ করলে। এ ধারাতে উল্লেখ আছে, ভাড়াটিয়া সম্পত্তির দখল নেওয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল, সেরূপ ভালো অবস্থায় রাখবে এবং মেয়াদ শেষে পূর্বাবস্থায় ফেরত দেবে। এ ধারামতে আরো উল্লেখ আছে, ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া ঘরের কোনো ক্ষতি হলে বাড়িওয়ালা তাকে সে সম্পর্কে নোটিশ দেবেন। ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া প্রদান করলে যতদিন মেয়াদ আছে ততদিন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে দখল করতে পারবে। ভিন্নরূপ কোনো চুক্তির অবর্তমানে ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালার লিখিত সম্মতি ছাড়া বাড়ির কোনো অংশ উপ-ভাড়া দিলে কিংবা ভাড়াটিয়া যদি এমন আচরণ করে যার দরুণ পার্শ্ববর্তী বাড়ির দখলকারীদের কাছে উৎপাত বা বিব্রতকর মনে হয় এবং ভাড়াটিয়া চুক্তিপত্রে উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও বাড়ির কোনো অংশ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা করতে অনুমতি দেন তাহলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে। বাসাবাড়ি, দোকানঘর, অফিস, গুদাম প্রভৃতি যদি মাসিক ভাড়ায় ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে ১৫ দিনের নোটিশে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যায়।

চুক্তিপত্রের মেয়াদ শেষ হলেও বাড়িওয়ালা যদি ভাড়া দিয়ে থাকেন, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে, বাড়িওয়ালা চুক্তিপত্রটি নবায়ন করেছেন। ভাড়াটিয়া নিয়মিত বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করা অবস্থায় যদি বাড়িওয়ালা তাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেন, তাহলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার ভাড়াটিয়ার রয়েছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের আইনটি কার্যকর না থাকার ফলে সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া কেউই মানছেন না এ আইন। শুধু বসতবাড়ি নয়, অফিস, দোকানসহ নানা ক্ষেত্রেই এ আইনটি প্রযোজ্য। তাই বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধ নিরসনের ক্ষেত্রে এ আইনের কার্যকারিতা এখন সময়ের দাবি।

 

সিরাজ প্রামাণিক

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

seraj.pramanik@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads