• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

কোটা সংস্কার : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

  • প্রকাশিত ১২ এপ্রিল ২০১৮

সারা দেশে শুরু হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। এই আন্দোলনে নিরন্তর যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী। তাদের কণ্ঠে উঠে আসছে- ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘কোটা সংস্কার চাই’, ‘নাতিপুতি কোটা বাতিল কর’। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে এভাবেই প্ল্যাকার্ড নিয়ে আন্দোলনে সোচ্চার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। কর্মসূচিতে বিক্ষোভকারীদের পাঁচ দফা দাবি : কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা।

 

একটি দেশে কোটা পদ্ধতি বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত অনগ্রসর জনগণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ— এই ১৬ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে ১০ শতাংশ জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এভাবে সরকারি চাকরিতে ২৫৭ ক্যাটাগরিতে কোটা চালু রয়েছে।

 

মূলত কোটাপ্রথা চালু হয়েছে পাকিস্তান পর্বে। তার বিস্তার ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশে। অনগ্রসর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের চাকরির ক্ষেত্রে ঠাঁই দিতে এই পদ্ধতি চালু হয়েছিল অনেক আগেই। তাতে মেধার প্রাধান্য হয়তো ততটা থাকত না। যুক্তি ছিল, রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করতে পারে না।   তবে কোটা পদ্ধতির কারণে কোটার বাইরে থাকায় যোগ্য ও মেধাবী অনেকেই নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব পদ খালি থাকায় সরকার ও রাষ্ট্র মেধাবী এবং যোগ্যদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। সরকারি চাকরি লাভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা নয়, বরং তাদের নাতি-নাতনিরাও কোটা পদ্ধতির আওতায় পড়বে। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীরা চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ পাচ্ছে। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এরপরও বিভিন্ন সময় কোটায় বিশেষ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যেমন- ৩২তম বিসিএস, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে বিশেষ কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

 

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের একমাত্র উদ্দেশ্য মানসম্মত সরকারি চাকরিলাভ। একটি চাকরি একটি পরিবারকে প্রতিষ্ঠা দেয়। ব্যক্তিজীবনকে উন্নত করে। সব যোগ্যতা থাকার পরেও একজন শিক্ষার্থী যখন তার আকাঙ্ক্ষিত চাকরিলাভে ব্যর্থ হন, তখন তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় অন্ধকার জগৎ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার অর্জিত শিক্ষা এবং বিবেক কাজে লাগিয়ে ন্যায়ভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে ন্যায়ের রাস্তাগুলো যখন তার জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা জন্মে। এ ঘৃণা তাকে এমন কতগুলো কাজ করতে প্রলুব্ধ করে, যার বদৌলতে শুধু ব্যক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রও মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়। বর্তমান সময়ে দেশের ১৭  কোটি জনগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বেকার। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, কোটার প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১৩ জনের পদ শূন্য ছিল। একইভাবে ২৯তম বিসিএসে ৭৯২ জন, ৩০তম-তে ৭৮৪ জন, ৩১তম-তে ৭৭৩ জন, ৩৫তম-তে ৩৩৮ জনের পদ শূন্য ছিল। এই শূন্য পদগুলো পূরণ করা যায় মেধা থেকে প্রার্থী নিয়োগ করার মাধ্যমে। এতে ব্যক্তি-পরিবার-রাষ্ট্র— সবাই উপকৃত হবে।

 

দেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এখন সময়েরই দাবি। সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে বিপুলসংখ্যক জনশক্তির জন্য শ্রমবাজার সৃষ্টি করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনা সম্ভব। কাজেই দেশে, দেশের বাইরে বেকারদের এবং যোগ্যদের তাদের প্রাপ্য স্থানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দিতে পারলে দেশের সর্ববৃহৎ সমস্যার যেমন সমাধান হবে, তেমনি দেশ অর্থনীতিকভাবেও গতিশীল হবে।

 

মানুষের মঙ্গল যে কাজের মধ্যে নিহিত, সে কাজই যেন আমরা করতে পারি। রাষ্ট্র দেশের মেধাবীদের মেধা ধরে রাখতে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করুক সেটাই কাম্য। কোনো বিশেষ শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে যেন অন্য মানুষকে বঞ্চিত করা না হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, এমনটাই বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিভিন্ন সময়ে কোটা পদ্ধতি নিয়ে ছাত্রদের পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপিত হয়েছে এবং তাদের সমাধানের আশ্বাস দিয়ে শান্ত করা হয়েছে। তবে সমাধান কখনোই হয়নি। তাই সরকারের উচিত দক্ষতার সঙ্গে এই কোটা সমস্যার সমাধান করা। তবেই বিজয় আসবে, বিজয় হাসবে শত শত আলোকবর্তিকাসম মেধাবীর ঠোঁটে। এই অধিকার রক্ষায় নিশ্চয়ই পাশে থাকবে সচেতন মানুষসহ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তার নাগরিকের চাওয়ায় প্রতিবন্ধক নয়— এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।

 

শান্তা ফারজানা

সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি ও সভাপতি, জাতীয় শিক্ষাধারা

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads