• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

নতুন লড়াই

  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০১৮

রোহিঙ্গা নিধনের সময় শান্তির জন্য সারা বিশ্বে নন্দিত এবং গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে কথিত অং সান সু চির ভূমিকায় বিস্ময়, হতাশা, নিন্দা ইত্যাদি প্রকাশ পাচ্ছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। সামরিক শাসকদের নিষ্ঠুরতার শিকার তিনি নিজেও যে হননি তা তো নয়। দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। বন্দি ছিলেন অনেক বছর। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষ তিনি; বঞ্চনার বেদনা তাঁর অজানা নয়, রোহিঙ্গাদের দুর্দশায় তাঁর পীড়িত হূদয় আর্তনাদ করে উঠবে- এটাই তো স্বাভাবিক ছিল! কিন্তু তিনি কেবল চুপ করে নেই, বর্বর সেনারা যে মগের মুল্লুক কায়েম করেছে তাকে নীরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।

সবই সত্য। কিন্তু আরও বড় সত্য হলো এটা যে, যে-উদারনীতির তিনি প্রতিনিধি, বাহকই বলা যায়, তার স্বভাবটা কিন্তু ওই রকমেরই। উদারনীতি ততক্ষণই উদার থাকে যতক্ষণ তার বস্তুগত স্বার্থে ঘা না লাগে। স্বার্থের বিপদ দেখলে পিছিয়ে আসে, রক্ষণশীল হয়ে পড়ে, প্রতিক্রিয়াশীল হতেও সঙ্কোচ করে না। কৃষকদের দুর্দশায় আর্তহূদয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে কৃষকের জন্য সহানুভূতিতে আপ্লুত হয়েও শেষ পর্যন্ত জমিদারিব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন এবং যুক্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’। সেই অবস্থান ও সংলগ্ন যুক্তি সকল উদারনীতিকেরই অন্তরের অন্তস্তলের ব্যাপার। উদারনীতিকরা সংস্কারে আপত্তি করেন না, কিন্তু বিপ্লবের নাম শোনামাত্র আঁতকে ওঠেন। কারণ যতই মানবতা ও ভদ্রতা দেখান না কেন আসলে তো তাঁরা সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানারই সমর্থক। উদারনীতিক অং সান সু চির পক্ষে তাই সামরিক জান্তার সঙ্গে ঐক্য গড়তে কোনো অসুবিধা নেই। পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো তো কেবল উদারনীতিক নন, আওয়াজে নামজাদা ‘বিপ্লবী’ই ছিলেন, কিন্তু মুনাফালোলুপতার তাড়নাতে তাঁর পক্ষেও অসুবিধা হয়নি নরপিশাচ ইয়াহিয়া খানদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে। অং সান সু চি তো বরং ধন্যবাদ পেতে পারেন অতটা অগ্রসর না হওয়ার কারণে।

রোমান ক্যাথলিকদের বিশ্ব ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের ভূমিকাতেও বাংলাদেশের মানুষ হতাশ হয়েছে। পোপ মানবাধিকারের প্রশ্নে বেশ সোচ্চার; পূর্ববর্তী ধর্মগুরুদের অনেকের তুলনাতেই তিনি প্রগতিশীল। রোহিঙ্গা নিধন যখন শুরু হয় এখন তিনি ‘রোহিঙ্গা ভাইবোনদের’ ওপর মিয়ানমারের সৈন্যদের অত্যাচারের নিন্দা করেছিলেন। তাই মিয়ানমারে তিনি যাচ্ছেন শুনে প্রত্যাশা জোগাচ্ছিল যে, আর কিছু না করুন হূদয়ের গভীরে ধারণা করা নিন্দাটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, ফলে বিশ্ববাসী আরও সহানুভূতিশীল হবে। তিনি গেলেন, ফিরে এলেন, রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটা কথাও বললেন না, এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ নামটিও উচ্চারণ করলেন না। ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা ওই একই। তিনিও উদারনীতিকই। নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখেন। নিশ্চয়ই ভেবেছেন যে, মিয়ানমারে ক্যাথলিকরা আছে, তাদের সংখ্যা এখন বাড়তির দিকে; সামরিক শাসকদের বিরক্তি উৎপাদন করলে সংখ্যাবৃদ্ধিতে বিঘ্ন তো ঘটবেই, সংখ্যালঘু ক্যাথলিকদের বিপদও ঘটতে পারে। নিজে বাঁচলে তবে না বাপের নাম। বাংলাদেশে এসে পোপ রোহিঙ্গাদের দুঃখ স্বচক্ষে দেখেছেন। কাতর হয়েছেন। ‘রোহিঙ্গা’ নামটি একবার হলেও উচ্চারণ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এমন ব্যাপারে তিনি কোনো ভূমিকা নেবেন- এটা দুরাশা মাত্র।

 

দুই.

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তাহলে লড়বে কারা? প্রশ্নটার জবাব এক কথাতেই দেওয়া সম্ভব; লড়বে সমাজতন্ত্রীরা। পৃথিবী এখন সুস্পষ্টরূপে ভাগ হয়ে গেছে- পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রীতে। পুঁজিবাদীরা পরিচিত, সমাজতন্ত্রীরা পরিচিত নন। পুঁজিবাদীরা সুসংগঠিত, সমাজতন্ত্রীরা নন। মূল কারণ পুঁজিবাদীদের হাতে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতাকে তারা পরিপূর্ণরূপে ব্যবহার করে সমাজতন্ত্রীদের দমন করার কাজে। তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ মুনাফা শিকার, দ্বিতীয় কাজ মুনাফার নিশ্চয়তা বিধানের ও মুনাফাব্যবস্থা রক্ষা করার স্বার্থে সমাজতন্ত্রীদের দমন করা। পুঁজিবাদীরা দমন করে ছলে-বলে-কৌশলে। তারা ছাড় দেয়; ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ কায়েমের মনোহর শোভা উপস্থিত করে। মেহনতিদের জন্য কিছু কিছু সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা যে করে না এমনও নয়, লুণ্ঠন করে আনা সম্পদের খুদকুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। যখন-তখন বলে, আমরা আধুনিকতা এনেছি, যার অর্থ দাঁড়ায় আদিম বর্বরতাকে নতুন মোড়কে ঢেকে দিয়েছি। প্রদর্শনী ঘটায় গণতন্ত্রের, যে গণতন্ত্র আসলে টাকার-থলের গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

পুঁজিবাদীদের হাতে আছে মিডিয়া, আলাদীনের জাদুর প্রদীপের মতো অপরিসীম তার ক্ষমতা; দিনকে রাত বানাতে পারে, ইচ্ছা করা মাত্র। মিডিয়ার সাহায্যে তারা পুঁজিবাদের মাহাত্ম্য প্রচার করে সর্বক্ষণ এবং চোখ-কান খোলা রাখে সমাজতন্ত্রীরা যাতে কোনো খান থেকে কোনো প্রকার প্রচার সহায়তা না পায়। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করা মিডিয়ার নিত্যদিনের দায়িত্ব। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারা পৃথিবীতে এখন আন্দোলন চলছে, কিন্তু তার খবর মিডিয়াতে আসে না। সমাজতন্ত্রীদের বিপক্ষে মিডিয়া যে কতটা অন্ধ ও নির্লজ্জ হতে পারে তার প্রমাণ বাংলাদেশেও আমরা পাই। ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় যে সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে তেমনটি সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু পুঁজিবাদী মিডিয়াতে তার খবর প্রায় আসেইনি; যেখানে এসেছে সেখানে আসতে পেরেছে নিতান্ত সঙ্কোচের সঙ্গে। অনেকগুলো জাতীয় দৈনিক তো দেখা গেল লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে, একটা অক্ষরও ছাপেনি। আসল সত্য অবশ্য ওই ভাগ হয়ে যাওয়াটা। পুঁজিবাদের শেষ বিধান এই যে, মধ্যপন্থা বিলুপ্ত হবে, উদারনীতির ছদ্মবেশটাও থাকবে না, থাকবে পুঁজিপন্থি ও সমাজতন্ত্রীরা, পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে।

বুর্জোয়ারা প্রচার করছে সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা জানে কিন্তু মানে না যে, সমাজতন্ত্র বিলোপ হওয়ার পাত্র নয়; এটি একটি আদর্শ, যেটি থাকবে; পুঁজিবাদই বরং বিদায় হবে— ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক কারণে। এবং পুঁজিবাদ নিজেই শর্ত তৈরি করে দিচ্ছে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য।

সাম্যের স্বপ্নটা মানুষ বহুকাল ধরে দেখেছে। সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব হয়েছিল ১৭৮৯ সালে, ফরাসি দেশে, সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বিপ্লব সফল হয়েছিল ১৮৭১ সালে, ওই দেশেরই রাজধানী প্যারিসে। টিকে ছিল ৭২ দিন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বড় আকারে গড়ে তোলা হয়েছিল রাশিয়াতে, তার প্রভাব গিয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। ব্যবস্থাটা এবার টিকেছিল ৭২ বছর। এইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এগোচ্ছে, কোনো এক দেশে বা অঞ্চলে নয়, বিশ্বজুড়ে। তার সফলতা অনিবার্য।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads