বাংলা সংস্কৃতি সম্প্রীতির, ভালোবাসার। হাজার বছরের এই সংস্কৃতি আমাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়। প্রাণখুলে হাসতে শেখায়, মানুষকে আপন করে নিতে শেখায়। বাংলার সংস্কৃতি প্রত্যেকটি নর-নারীকে বাঙালি ঐতিহ্য লালনে উদ্বুদ্ধ করে এবং অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে জাগ্রত ও শক্তিশালী করে। সমৃদ্ধিশালী বাংলা সংস্কৃতির শক্তিমান অবয়ব বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে, ঈর্ষান্বিত করে। এ আমাদের এক অনন্য মর্যাদার প্রাপ্তি। আমরা গর্বিত জাতি যে, আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে, নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, নিজস্ব বর্ষপঞ্জি আছে। এগুলো আমাদের নিজস্বতার প্রমাণ বহন করছে যুগ যুগ ধরে।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়। সেই সময় প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন। পহেলা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং কিছু আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হতো। পহেলা বৈশাখ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি মূলত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন নিয়মকানুনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে কাজকর্ম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ছিল। তখন মহাজন ও ব্যবসায়ীরা বৈশাখেই হালখাতা অনুষ্ঠান চালু করেন। হালখাতা হলো যে বছরটি চলে গেল সেই বছরের হিসাবের যোগ-বিয়োগ করে পুরনো খাতাটি তুলে রেখে নতুন বছরের প্রথম দিন নতুন খাতায় হিসাব চালু করা। প্রবীণরা বলেন, লালসালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো নতুন এই হিসাবের খাতার ওপর লেখা হতো ‘এলাহী ভরসা’। এই এলাহী শব্দটিও সম্রাট আকবরের ‘তারিখ ই এলাহী’ থেকে এসেছে বলে জানা যায়। আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে হালখাতার পূর্বে সারা বছরের হিসাবনিকাশ চূড়ান্ত করে বাকি-বকেয়া আদায় করা হতো এবং সে সময়ে দেনাদারকে রেয়াত বা ছাড় দেওয়া হতো। আবার ব্যবসায়ীরা নানান উপঢৌকন পাঠাতেন বিভিন্ন বাড়িতে বা ব্যবসায়ীদের। উৎসবমুখর পরিবেশে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হতো। এ ছাড়া চৈত্র-সংক্রান্তিতে বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান এবং নতুন বছরের শুরুতে যাতে ফসল ভালো হয়, সেজন্য প্রার্থনা করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো, একে অন্যকে মিষ্টি-মুখ ও শুভেচ্ছা বিনিময় ইত্যাদি চলত আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে।
সেই উৎসবের ধারাবাহিকতায় নবরূপে চলছে আমাদের নববর্ষ উদযাপন, আনন্দ র্যালি বা মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাঙালির প্রাণের উৎসব। বর্ষবরণ উৎসবের বিশেষ অনুষঙ্গ হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বাংলাদেশ চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে আনন্দ র্যালি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর এটি এখন আর আমাদের নিজস্ব উৎসব নয়, বরং এটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাত্রা। এ উৎসব এখন বিশ্ববাসীর।
সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনাচার আর আবেগের বহির্প্রকাশ। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় একটি জাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার চিত্র। আর সংস্কৃতির উৎস মানেই লোক-সংস্কৃতি। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা লোক-সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। ময়মনসিংহ গীতিকা, পালাগান ইত্যাদি এ অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার প্রগতি এই জেলার মানুষের মনকে দিয়েছে সরলতার অকৃত্রিম ছোঁয়া।
ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৮৭ সাল থেকে নববর্ষে আনন্দ র্যালি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ বরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’-এই স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে মঙ্গল শোভাযাত্রা উদ্যাপন কমিটি ও শহরের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। রাজধানী ঢাকার পর সর্ববৃহৎ মঙ্গল শোভাযাত্রা ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেকেই মনে করেন। এবার আনন্দ র্যালিতে ৮৩টি বাঙালি সংস্কৃতির উপাদান সংযুক্ত করে প্রদর্শনের প্রস্তুতি চলছে। বাঙালি সংস্কৃতির সব অনুষঙ্গ নতুন প্রজন্মের সম্মুখে তুলে ধরা এবং তাদের এর সঙ্গে পরিচয় ঘটানো এই আয়োজনের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য। প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ এই মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বর্ষবরণ উৎসবের মূল আকর্ষণ। অনেক বিবাহিত নারী এই র্যালিতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নাইওরি হয়ে আসেন। এই বর্ণিল আয়োজন কতটা আড়ম্বরপূর্ণ তা না দেখলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। পুরো ময়মনসিংহ শহর যেমন বৈশাখী আমেজে মেতে ওঠে, তেমনি গ্রামাঞ্চলেও নানা ধরনের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এই মঙ্গল শোভাযাত্রার বৈশিষ্ট্য হলো প্রায় সব জাতীয় প্রতীক যেমন- জাতীয় ফুল, জাতীয় পাখি, জাতীয় প্রাণী ইত্যাদির নকশা করা হয়, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, পালকি, ধান ভানার ঢেঁকি, কুলা-চালনি, মাছ ধরার পলো, বাঙালি নববধূর সাজ, রাজ-রানীর পোশাকের সাজ ইত্যাদি নানান উপকরণে তৈরি করা হয়। মেয়েরা লাল-সাদা শাড়ি আর ছেলেরা বাহারি পাঞ্জাবি পরবে, এতে কোনো রকম ভুল নেই। এই দিনটিকে ঘিরে নানান ঐতিহ্যবাহী খেলা যেমন- লাঠিখেলা, ঘোড়া দৌড়, ঘুড়ি উড়ানো, নৌকাবাইচ, সাপ খেলা, বানর খেলা ইত্যাদিও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া থাকে নকশিকাঁথার প্রদর্শনী, ঢোলক দল, খোলের বাদ্য, চাকী, মন্দিরা, সানাই ও ব্যান্ডপার্টি, তালপাখা, বাঁশি, একতারা দোতরা ইত্যাদি। আরো রয়েছে বাউল গান, জারি গান, কবি গান ও বায়স্কোপ ইত্যাদি।
ঐতিহ্যগতভাবে শহরের মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। এরপর শহরের প্রধান সড়ক স্টেশন মোড়, গাঙ্গিনার পাড়, নতুন বাজার মোড়, জিলা স্কুল মোড়, টাউন হল মোড়, কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক হয়ে পণ্ডিতপাড়া ক্লাবের সামনে দিয়ে সাহেব কোয়ার্টার পার্কে (সার্কিট হাউজ মাঠ সংলগ্ন) জয়নুল আবেদীন পার্কের বৈশাখী মঞ্চে গিয়ে শোভাযাত্রা সমাপ্ত হয়। শোভাযাত্রা শেষে বর্ষবরণ উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ময়মনসিংহ জেলার শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পগোষ্ঠী, ব্রহ্মপুত্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, সিঁড়ি সাংস্কৃতিক পরিষদ, জয়নুল আবেদিন চারুকলা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনায় মুখর হয়ে ওঠে পুুরো শহর। ব্রহ্মপুত্র নদীর পার ঘেঁষে লাখো মানুষের ঢল নামে। নতুন পুরাতনের মেলবন্ধনে এ এক অভাবনীয় দৃশ্য! বাঙালির প্রাণের উৎসব। এক যেন এক মহামিলন।
ময়মনসিংহ গীতিকায় বাংলা নববর্ষের আবাহন ধ্বনিত হয়েছে-‘আইল নতুন বছর লইয়া নব সাজ, কুঞ্জে ডাকে কোকিল-কেকা বনে গন্ধরাজ।’ এই হলো আমাদের বাঙালি ঐতিহ্য, এটাই হলো আমাদের বৈশাখের ঐতিহ্য, যেকোনো বাধাবিপত্তি পেরিয়ে, সহস্র প্রতিকূলতা ছাড়িয়ে আমাদের মাতিয়ে তোলে নব প্রেরণায়। গত বছর ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভের পর থেকে দেশের সর্বত্র ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বর্ষবরণ উৎসব পালিত হচ্ছে। আশা করা যায়, এবারের আয়োজনে থাকবে ভিন্নমাত্রা, থাকবে মানুষকে ভালোবাসার গান। শান্তি, ঐক্য ও সম্প্রীতির শপথই বাঙালির সংস্কৃতির শক্তিশালী অবয়ব- যা প্রতিটি বাঙালিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে। প্রেরণা জোগায় দেশকে ভালোবেসে দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হতে। কিন্তু রূঢ় হলেও সত্য, এদেশের কিছু সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার চেষ্টা করেছে বাংলার সংস্কৃতিকে রুখে দিতে, বৈশাখের উৎসব ও ঐতিহ্যকে রুখে দিতে। তারা ইতিহাসকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, তারা বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে প্রচার করেছে। বিগত বছরে রমনার বটমূলে বোমা হামলা, যশোরে উদীচীর ওপর বোমা হামলার ঘটনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নারীদের লাঞ্ছনার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের উত্তরণ প্রয়োজন। তাহলে বাঁচবে সংস্কৃতি, বাঁচবে ঐতিহ্য, বাঁচবে দেশ। দেশের স্বার্থে সবাইকে শপথ নিতে হবে, এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব তথা জঙ্গিবাদকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় বা সমর্থন দেওয়া যাবে না। নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে বাংলা সংস্কৃতির মর্যাদা। আর এজন্য বাংলা সংস্কৃতির লালন, সুষ্ঠু চর্চা ও সম্প্রসারণ প্রয়োজন।
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করাই হোক নববর্ষের প্রত্যয়। ১ বৈশাখ নববর্ষবরণ উদযাপনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চলুন মেতে উঠি প্রাণের আবেগে আনন্দ উল্লাসে। নতুন বছর মানে নতুন সূর্যোদয়, নতুন বছর মানে নতুন প্রত্যয়। আসুন মানুষকে ভালোবেসে মানুষের সেবায় নিজিকে বিলিয়ে দিই। নতুন বছর সবার জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনুক। সবার জীবন কালিমামুক্ত হোক, পরিপূর্ণ হোক। নব আনন্দে জেগে উঠুক প্রাণ।
জয়িতা শিল্পী
পুলিশ কর্মকর্তা