• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

অসাম্প্রদায়িক চেতনার নির্দেশক পহেলা বৈশাখ

  • প্রকাশিত ১৫ এপ্রিল ২০১৮

ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন থেকে শুরু হয় আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র আমরা হারিয়ে ফেললেও জাতিগতভাবে আমাদের ভেতরের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, তা এখনো জেগে আছে। জেগে যে আছে, হারিয়ে যে যায়নি; বাঙালি যে অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা এখনো ধারণ করে বুকের গভীরে—এই সত্য আরো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় পহেলা বৈশাখে। বাঙালির প্রাণের এই উৎসব পহেলা বৈশাখই মনে করিয়ে দেয় আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা।

বারো মাসের তেরো পার্বণের বাঙালি জীবন থেকে নানা কারণে যদিও হারিয়ে যাচ্ছে উৎসবের রঙ, আমরা আটকে পড়ছি দিবসের ফাঁদে। আমাদের উৎসব-পার্বণ হয়ে উঠছে দিবসকেন্দ্রিক। শুধু পহেলা বৈশাখই নয়, আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভাষাশহীদদের স্মরণে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবসে—কেবল ঢাকা শহরেই নয়, সারা দেশেই মানুষ ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

এই দিনগুলোতে নারী-পুরুষ-শিশুদের উৎসবের রঙে মেতে ওঠার উচ্ছ্বাস মনে করিয়ে দেয়, দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মানুষ স্বস্তি চায়। অথচ সকালে পথে বেরিয়ে আসা এই মানুষগুলো যখন সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে, তখন তাদের মনে কি সত্যিকার অর্থেই লেগে থাকে উৎসবের রঙ? তারা কি নিজেদের রাঙিয়ে নিতে পারে নতুন কোনো রঙে? যে রঙ তাকে, তাদের এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে দেবে? সত্যিকার অর্থেই আজ আমাদের সামনে নেই সে রকম কোনো দিকনির্দেশনা। আমরা প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলছি নিজেদের বলার কথাগুলো। অন্যের শেখানো বুলি, অন্যের ভাব-ভাষা ধার করে আমরা নিজেদের প্রকাশ করছি। ফলে আমাদের নিজস্বতা বলে থাকছে না কিছুই। সাধারণ মানুষও তার নিজের কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

অথচ যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা আমরা বলি, যে অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্ন থেকে মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের ফিরিয়ে দিতে পারে কেবল পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে এ ধরনের উৎসবের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা যত বাড়বে, আমাদের মুক্ত মানুষ হয়ে ওঠার পথ তত বেশি মসৃণ হবে। একটি জাতি যখন চাওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে, তখন জাতি হিসেবে তাদের মৃত্যু ঘণ্টাই বেজে ওঠে। আমরা একদিকে যেমন রাজনীতির ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি হারিয়ে ফেলেছি আমরা কোথায় যেতে চাই—সেই পথ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষ এখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সামষ্টিক হওয়ার আগ্রহ সে খুইয়ে ফেলছে দিকনির্দেশনার অভাবে, কাণ্ডারির অভাবে। অথচ দিবসভিত্তিক দিনগুলোতে পথে নেমে আসা মানুষ দিন শেষে শুধু ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে চায় না। তারও মনের ভেতরে গুনগুন করে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। ব্যক্তি মানুষের এই ইচ্ছাকে যদি আমরা সমষ্টির রূপ দিতে পারি, তাহলেই জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়। এক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের ফিরে পাওয়ার সেই পথ প্রশস্ত হতে পারে পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসব পালনের মাধ্যমে।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পেছনের। ফসলি সন গণনার যে রীতি সেই রীতি ধীরে ধীরে গর্ব আর স্বাতন্ত্র্যের ভেতর দিয়ে মিশে গেছে আমাদের গণসমাজের সঙ্গে। তাকে গায়ের জোরে একাকার করে দেওয়া হয়নি। বরং মানুষ এই উৎসবকে চিরকালের করে নিয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মৌলধারায় মূল্যবান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। কিন্তু গায়ের জোরে এই উৎসবকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা হয়েছে, উৎসবের রঙে কালিমা লেপে দেওয়া  হয়েছে, সম্প্রীতির সূত্রকে ছিন্ন করতে রক্তাক্ত করা হয়েছে এই উৎসব। বাঙালির প্রীতি ও সহিষ্ণুতার গায়ে, তার সাংস্কৃতিক ঐক্যে যন্ত্রণার ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে। তবুও বাঙালির কোনো ভীতি থেকে তার প্রাণের এই উৎসবকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। সব অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালি আত্মসচেতন হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে উৎসব আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। বাংলা নববর্ষকে আনন্দময় করে তুলতে মূল ভূমিকা পালন করেছে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। নানারকম অভিযোগের পরও এই শ্রেণিটিই সমাজে দাপটের সঙ্গে চলমান— যারা সমাজের মূল স্রোতকেও নির্দেশ করে। তারাই যান্ত্রিক জীবনের মানবিক অনুভূতি শূন্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পহেলা বৈশাখের উৎসবকে করে তুলেছে সর্বজনীন। ফলে একসময় যে উৎসবের সঙ্গে বাংলার কৃষকের, কৃষির, খাজনার বড় অংশ জড়িয়ে ছিল, তা হয়ে উঠেছে শহুরে স্বতঃপ্রবৃত্ত এক উৎসব। কিন্তু এখানে একটা অসুবিধার কথা এখন শনাক্ত হয়ে উঠছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশই যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাইরে নিজেদের সক্রিয় করে তুলছে বলা হলে কথাটিকে কেউই আজ আর অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ভুল করেন না। কারণ আমাদের দুর্ভাগ্য, বিভিন্ন সময়ে একদিকে সামরিক শাসন যেমন আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে, তেমনিভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার দুরভিসন্ধি থেকেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশকেই ঠেলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে সাম্প্রদায়িক চিন্তার দিকে। অসাম্প্রদায়িকতা থেকে এই যে আমাদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া-তা বিভিন্ন কৌশলে ধীরে ধীরে রক্তের ভেতরে বপন করে দেওয়ার চেষ্টা চলে আসছে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ছিল আমাদের লড়াই, সেই লড়াই এখনো চলমান। পার্থক্য দৃশ্যমান অপশক্তিকে আমরা চিহ্নিত করেছিলাম একাত্তরে, কিন্তু তাদেরই ভূত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেও তাদের যাত্রাপথকে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছে। আর এর পেছনে রয়েছে আমাদের সীমাবদ্ধতার দিকে দৃষ্টি না দেওয়া। সমাধানসূত্র না খুঁজে, আমাদের ভুলগুলো চিহ্নিত না করে অহরহ শুধু অভিযোগের পাহাড় তৈরি করা হয়েছে। ফলে যে সমস্যাকে অঙ্কুরেই উপড়ে ফেলা যেত, তাকে মহীরুহ হয়ে উঠতে দেওয়া হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক পহেলা বৈশাখের উৎসবের বিরুদ্ধে মানুষকে অনাগ্রহী করে তোলার প্রয়াস পেয়েছে অপশক্তি। নিজেদের পরিচয় অস্পষ্ট রেখে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতরে বুনে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। যাতে করে উৎসবের সঙ্গে অন্তরের যোগ কমতে শুরুর আশঙ্কাও রয়ে গেছে। আজ আর অবহেলা করার সময় নেই, যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে, তা দূর করে অসাম্প্রদায়িকতার পথে আমাদের যাত্রাপথ মসৃণ করতে হবে। আর এই এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন মুক্তমন। কারণ অসাম্প্রদায়িকতার যে ধারা আমাদের ভেতরে প্রবহমান তাকেও তিলে তিলে মিশিয়ে দিতে দিতে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ মেরে দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। দেশের ভেতরে-বাইরে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের তকমা এঁটে দিতে আমাদের কত না ফিকির। অথচ এর কিছুই হওয়ার কথা ছিল না। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের পরিচিত হওয়ার সম্ভাবনা এখনো অপার। মুক্ত মানুষই পারে দেশকে সত্যিকারের ভালোবাসতে, দেশকে এগিয়ে নিতে।

 

মামুন রশীদ

সাংবাদিক, কবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads