• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

বিয়ে নিয়ে প্রতারণা রোধে আইন যা বলে

  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৮

রিমি ও সুজন (ছদ্মনাম) দু’জনে ভালোবেসে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। তারা এ বিয়ের কথা পরিবারের কাউকে জানায়নি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই রিমি বিয়ের কথা গোপন রেখে পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী আবার বিয়ে করে। প্রিয়াকে হারিয়ে পাগল হয়ে ওঠে সুজন। বিয়ে নিয়ে রিমির এ প্রতারণার বিরুদ্ধে রয়েছে আইনগত সমাধান। আরো একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, সেটি হলো সুজিত ও শান্তার (ছদ্মনাম) ঘটনা। এই দু’জনের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক। হঠাৎ ঠুনকো এক বিষয় নিয়ে দু’জনের সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। আর একটা ঘটনার কথা বলা যায়, সেটি হলো সুজন নামক এক ব্যক্তি যিনি ফন্দি-ফিকির করে একটি ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে শান্তাকে স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। এ নিয়ে উভয় পরিবার উদ্বিগ্নতার মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। কিন্তু কীভাবে হবে এর আইনগত সমাধান?

ছন্দা ও শহিদের (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়নি। অথচ বিয়ে হয়েছে— এমন কথা বলে মিথ্যা প্রমাণ দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘর-সংসার করতে থাকে। একসময় ছন্দা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। শহীদ বিয়ে অস্বীকার করে এড়িয়ে চলে। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ ও পিতৃ-পরিচয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ছন্দা। আর রহমান সাহেব (ছদ্মনাম) প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেন। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান স্ত্রী সানজিদা (ছদ্মনাম)। কিন্তু তিনি জানেন না যে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, আর বিয়ে যদি করতেই হয় তবে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া আবশ্যক।

উপরোক্ত চারটি ঘটনা আমাদের সমাজে নিতান্তই পরিচিত ঘটনা। এগুলো বিয়ে-সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এসবের রয়েছে আইনগত প্রতিকার। ডিএফ মোল্লা তার ‘মুসলিম আইনের মূলনীতি’ বইয়ে বিয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিবাহ বা নিকাহ এমন একটি চুক্তি যার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো বৈধভাবে সন্তান লাভ ও প্রতিপালন।’ বিচারপতি মাহমুদ তার ‘আ. কাদির ও সালিশি মোকদ্দমা’র রায়ে বলেছেন, ‘মুসলিম বিবাহ কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, একটি বিশুদ্ধ দেওয়ানি চুক্তি, যার উদ্দেশ্য পারিবারিক জীবনযাপন ও বৈধ সন্তান দান।’

দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা থেকে ৪৯৬ ধারা পর্যন্ত বিয়ে-সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের শাস্তির বিধান আছে, যার অধিকাংশ অপরাধই জামিন অযোগ্য। ধারা ৪৯৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে হয়নি এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী ১০ বছর বা যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৪৯৪ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় বিয়ে করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

৪৯৫ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি আগের বিয়ের তথ্য গোপন করে দ্বিতীয় বা পরবর্তীতে বিয়ে করেন তাহলে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ৪৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আইনসম্মত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত প্রতারণামূলকভাবে বিয়ে সম্পন্ন করেন, তাহলে অপরাধী সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো নারীর সঙ্গে তার স্বামীর সম্মতি ব্যতীত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তা যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে তিনি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন এবং এর শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডসহ উভয় দণ্ড হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বিবাহিত নারীকে অন্যের স্ত্রী জানা থাকা সত্ত্বেও ফুসলিয়ে বা প্ররোচণার মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোথাও নিয়ে যাওয়া এবং তাকে অপরাধজনক উদ্দেশ্যে আটক রাখা অপরাধ। এ ধারা অনুযায়ী অপরাধী দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডসহ উভয় ধরনের শাস্তি পেতে পারে।

কোনো মুসলমান ব্যক্তি যদি প্রথম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া এবং প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া আরেকটি বিয়ে করেন, তাহলে তিনি ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ (৫) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হলে ওই ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যেতে পারে। অনুমতির জন্য ফি দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে এবং আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ের অনুমতি দিতে যেসব বিষয়ের প্রতি বিবেচনা করা হবে, তার মধ্যে অন্যতম হলো : ১. বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, ২. শারীরিক মারাত্মক দুর্বলতা, ৩. দাম্পত্য জীবন-সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা, ৪. দাম্পত্য অধিকার পুনর্বহালের জন্য আদালত থেকে প্রদত্ত কোনো আদেশ বর্জন, ৫. মানসিকভাবে অসুস্থতা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, সালিশি পরিষদে যদি বর্তমান স্ত্রী অনুমতি না দেন, তাহলে কোনোভাবেই দ্বিতীয় বিয়ে করা যাবে না।

দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে প্রথম স্ত্রী যদি সন্তানদের নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করেন তবুও স্বামীকে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে হবে। স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে স্বামী আইনত বাধ্য থাকবে। ভরণপোষণ ছাড়াও স্ত্রী ও সন্তানরা উত্তরাধিকারীর অধিকার লাভ করবেন। এমনকি পূর্বের স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন। ‘মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯’ অনুযায়ী ভুক্তভোগী ওই স্ত্রী তার এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

বিয়ে-সংক্রান্ত অপরাধের জন্য অভিযোগ থানা বা আদালতে গিয়ে চাওয়া যাবে। থানায় এজাহার হিসেবে মামলা দায়ের করতে হবে। কেউ কেউ থানায় না গিয়ে সরাসরি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করে থাকেন। আদালতে মামলা করার সময় যথাযথ প্রমাণসহ অভিযোগের স্পষ্ট বর্ণনা দিতে হবে এবং সাক্ষীদের নাম-ঠিকানাও দিতে হবে। আদালত অভিযোগকারীর জবানবন্দি গ্রহণ করে যেকোনো আদেশ দিতে পারেন। অনেক সময় অভিযোগ আমলে না নিয়ে প্রাথমিক তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

বিয়ে যেভাবেই সম্পন্ন হোক না কেন কাবিননামা কিংবা বিয়ের সব দলিল নিজের কাছে রাখা উচিত। কাবিননামার ওপর কাজির সিল স্বাক্ষর আছে কি না যাচাই করে নিতে হবে এবং কোন কাজীর মাধ্যমে বিয়েটি সম্পন্ন হলো তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যতা যাচাই করে নেওয়া ভালো। মুসলিম বিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এটা স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই মনে রাখতে হবে। বর্তমানে হিন্দু বিয়ের নিবন্ধনও ঐচ্ছিক করা হয়েছে। বিয়ের হলফনামা করা থাকলে তা সংগ্রহে রাখতে হবে।

 

সিরাজ প্রামাণিক

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

seraj.pramanik@gmail.com

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads