• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

চরের চিঠি

দারিদ্র্য-অপুষ্টিতে বাড়ছে প্রতিবন্ধী শিশু

  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০১৮

দরিদ্রতার কারণে অপুষ্টিতে ভুগছে বিশ্বের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। আর বিশ্বে অপুষ্টির হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত দশ বছরে বাংলাদেশে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সাত লাখ। এর মধ্যে দেশে পুষ্টিহীন নারীর সংখ্যা ৬০ শতাংশ। মূলত আমাদের দেশের নারীরা এতই মমতাময়ী যে, রান্নাবান্না করে খাবার বানিয়ে ভালো অংশটি তুলে দেন সন্তান-স্বামীর পাতে। ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারগুলোর নারীদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রকট। কিন্তু মায়েরা জানেন না, তিনি অপুষ্টিতে ভুগলে গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্ম নিতে পারে। অথচ এমন গরিব পরিবারও আছে, যাদের ঠিক মতো তিন বেলা খাবারই জোটে না। তাদের কাছে পুষ্টির বিষয়টি গৌণ থেকে যায়। সম্প্রতি ‘দারিদ্র্য-অপুষ্টির কারণে কুড়িগ্রামে প্রতিবন্ধী শিশু বাড়ছে’ শিরোনামে জাতীয় এক দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জন্মসূত্রে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলায় জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠার সুবাদে এখানকার দারিদ্র্যের নির্মম চিত্র নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে।

চিলমারী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটি পুরোপুরি এবং বাকি কয়েকটির আংশিক সর্বগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। এসব চরে বসবাসরত মানুষের নদী ও চরকেন্দ্রিক উপার্জনই একমাত্র অবলম্বন। বলতে গেলে কৃষিকাজ, মাছ ধরা, নৌকায় মাঝিমাল্লার পেশার ওপর নির্ভর করে চলে তাদের জীবন-জীবিকা। দুর্গম এসব চরের মানুষের দারিদ্র্যই নিত্যসঙ্গী। তাদেরই একটি পরিবার আনোয়ারা খাতুনের। বাড়ি তো নয়, এক চিলতে জমির ওপর ভাঙা টিনের ঘর। স্বামী আবু বকর অষ্টমীর চরের এক দিনমজুর। শ্রম বিক্রিই যার প্রধান পেশা। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া দুই ছেলেই প্রতিবন্ধী। ওদের ভালো কোনো চিকিৎসকের নিকট নেওয়ার সুযোগ কোনো দিনও হয়নি তাদের। গ্রামের কবিরাজের কাছে ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবজই তাদের সান্ত্বনা। ওরা মনে করে, সৃষ্টিকর্তার দান সন্তান! প্রতিবন্ধী সন্তান হলেও প্রতিটি বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসার কমতি থাকে না। মূলত অপুষ্টিজনিত কারণে বিকলাঙ্গ প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম হয়। শুধু অষ্টমীর চরই নয়, এই চরের মতো কুড়িগ্রামে চার শতাধিক চরে চার লাখ মানুষের বসবাস। এসব চরে প্রতিনিয়তই প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের ২০১৬-১৭ সালের জরিপ মতে, কুড়িগ্রামে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে কার্ডধারী প্রতিবন্ধী ৩০ হাজার ৮৯১ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমা শাহিন বলেন, মায়ের গর্ভকালীন অয়োডিনের ঘাটতি ও পুষ্টির অভাবে বিকলাঙ্গ কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রামে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬-এর তথ্য অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যদিও জাতীয়ভাবে দাবি করা হয়, দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সরেজমিন প্রতিবেদনে দেখা যায়, চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর চরে একাধিক পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো পরিবারে সব সন্তানই প্রতিবন্ধী। এই চরেরই কোদালকাটি ডাটিয়ার চরের বাসিন্দা হামিদা বেগম। স্বামী আজাহার আলী নৌকায় মানুষ পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই দম্পতির দুই ছেলের একজনকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলের দুই সন্তানই প্রতিবন্ধী। অর্থাৎ কুড়িগ্রাম জেলার প্রতিটি চরে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণই যেখানে মুখ্য, সেখানে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার নিয়ে গরিব মানুষের ভাবার সুযোগই বা কোথায়! এ জেলায় শিল্প-কলকারখানা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। শ্রমশক্তিই যাদের সম্পদ। এই শ্রমশক্তিকে সম্বল করে এ জেলার কর্মক্ষম মানুষগুলো বাসে গাদাগাদি করে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমায় দেশের নানা প্রান্তে। সেখানে রুজি করে অর্থ পাঠায়, যা দিয়ে চলে ওদের জীবন-জীবিকা। কৃষিনির্ভর এ জেলায় চাষাবাদে যথেষ্ট সমৃদ্ধি এসেছে, কিন্তু কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান সেভাবে স্থাপিত হয়নি। ফলে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েই গেছে।

আবার এ জেলায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট চালকল শিল্পও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। এসব শিল্পে কর্মরত হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। অবশ্য সরকার বাস্তব এ অবস্থাকে আমলে নিয়ে দেশের গরিব ও প্রান্তিক মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তি, পুষ্টির ঘাটতি পূরণে আয়রনসমৃদ্ধ চাল বিভিন্ন সহায়তা প্রকল্পে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় পালইট প্রকল্প হিসেবে জেলার সদর ও ফুলবাড়ী উপজেলায় সরকার কার্ডধারীদের মধ্যে ১০ টাকা দরে এই পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল বিতরণ করেছে। কিন্তু সীমিত সংখ্যক কার্ডধারীর মধ্যে ১০ টাকা কেজির পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল বিতরণ করলেই হবে না, পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল-আটা দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সহায়ক কর্মসূচি, যেমন— ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, টিআর, কাবিখা প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হবে।

পুষ্টিজনিত সমস্যা শুধু কুড়িগ্রাম জেলাতেই নয়। কমবেশি দেশের সর্বত্রই এ সঙ্কট দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএম) ২০১৬-এর তথ্য মতে, দিনাজপুরের দারিদ্র্যের হার ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাকবলিত জেলা কুড়িগ্রামের পরই এটা দারিদ্র্যের সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের জরিপে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের অবস্থা সবার ওপরে বিরাজ করছে। খালবিল, নদী-নালাবেষ্টিত এ জেলার মানুষের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ যে কর্মসংস্থানের অভাব- তা আগেই বলেছি। এ অবস্থা থেকে এ জেলার মানুষকে অব্যাহতি দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কর্মসংস্থান উপযোগী শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করা। যেহেতু এ জেলায় কর্মক্ষম বেকার মানুষের সংখ্যা বেশি এবং এখানে এখনো তুলনামূলক কম শ্রমমূল্যে শ্রমিক মেলে, সেহেতু এ জেলায় লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও সম্ভব। আবার সরকারও যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিল্পাঞ্চল জোন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে কুড়িগ্রাম জেলা সদরে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শিল্পায়ন জোন করার উদ্যোগ নিলে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। একমাত্র কর্মসংস্থানের পথকে সম্প্রসারিত করা গেলে এতদাঞ্চলের খাদ্য ও পুষ্টির অভাব দূর করা সম্ভব হবে। তা না হলে দরিদ্রতার নির্মম অভিশাপ থেকে এ জেলার মানুষকে রক্ষা করা কঠিন হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, এখনো অনেকেই মনে করেন, প্রতিবন্ধী সন্তান পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা। যদিও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট (মৈত্রী শিল্প) পরিচালিত ওয়াটার প্লান্টে অনেক প্রতিবন্ধী কাজ করছেন। মুক্তা পানি নামে বোতলজাত পানি বিপণন করে সংস্থাটি মুনাফাও করছে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছেন অনেকেই, কিন্তু সবার ভাগ্যে লেখাপড়ার সুযোগ কিংবা কাজের যথেষ্ট সুযোগ এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধী দিবসের এক আলোচনা সভায় নির্দেশ নিয়েছেন, প্রতিবন্ধী প্রতিটি শিশুর লেখাপড়া নিশ্চিত করতে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। আমরাও মনে করি, প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়া কোনো অভিশাপ নয়। প্রতিটি প্রতিবন্ধী শিশুর লেখাপড়া নিশ্চিত করে কর্মক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সুযোগ দিলে বোঝা নয়, ওরা সমাজ ও রাষ্ট্রের আশীর্বাদও হতে পারে।

 

আব্দুল হাই রঞ্জু

প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads