• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলা

  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০১৮

রেসলিং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একটি বিনোদন। রেসলিংয়ের বাংলা নাম কুস্তি। কুস্তি অনেক পুরনো একটি খেলা। মধ্যপ্রাচ্যে এই খেলাটির একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। বর্তমানে অলিম্পিকসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কুস্তি একটি অন্যতম ইভেন্ট। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মতো বাংলাদেশেও কুস্তি খেলার রয়েছে অনেক জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এর রয়েছে বিশেষ একটি মর্যাদা। চট্টগ্রামে প্রতিবছর ১২ বৈশাখ উৎসবমুখর পরিবেশে কুস্তি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। যাকে বলা হয়, জব্বারের বলী খেলা। এ বছর ১০৭তম আসর অনুষ্ঠিত হবে। 

‘বলী’ শব্দটি এসেছে বলবান থেকে। মুঘল আমলে বিত্তবান এবং ভূ-স্বামীরা নিরাপত্তা ও আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য বেতনভোগী নামিদামি কুস্তিগীর পুষতেন। তাদের দৈহিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হতো বলী খেলার মাধ্যমে। যে বলবান কুস্তিতে বিজয়ী হতেন তাকে ‘বলী’ বলা হতো। ‘বলী’ খেলার স্বর্ণযুগ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত। সে সময় চট্টগ্র্রাম জেলার সর্বত্র চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত ‘বলী’ খেলার আয়োজন করা হতো। তখন এ অঞ্চলের অনেকেই ছিলেন ইয়াঙ্গুন তথা মিয়ানমার প্রবাসী। তাদের বলা হতো রেঙ্গুইন্যা। রেঙ্গুইন্যাদের হাতে ছিল প্রচুর অর্থ, ফলে তারাই ছিল বলী খেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পরে রেঙ্গুইন্যা ছাড়াও প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তি ‘বলী’ খেলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঢাকার নবাব আবদুল গণিও ‘বলী’ খেলার একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু পরে একটি সময় পৃষ্ঠপোষকের অভাবে বলী খেলার ধুমধাম অনেক জায়গায় ম্লান হয়ে পড়েছিল।

বর্তমানে চট্টগ্রামের বলী খেলাকে জব্বারের বলী খেলা বলা হয়। চট্টগ্রামে প্রচলিত বর্তমানের বলী খেলার প্রবর্তক আবদুল জব্বার নামে এক সওদাগর। তার  নামানুসারে বর্তমানে এই খেলাকে জব্বারের বলী খেলা বলা হয়। আবদুল জব্বার ছিলেন নগরীর বদরপাতী এলাকার তৎকালীন প্রভাবশালী সমাজসেবক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুবসমাজকে সংগঠিত করা, প্রেরণা দেওয়া এবং সংগ্রামী করে গড়ে তোলা। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ, বাংলা ১৩১৫ সালের ১২ বৈশাখ আবদুল জব্বার এই বলী খেলার সূচনা করেন। তিনি থাকতেন এই খেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি।

বর্তমানে বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। বলী খেলার আগে ঢোল বাজিয়ে প্রচারকার্য চালানো হয়। বলীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সঙ্গী ও সমর্থকদের নিয়ে ঢোল বাজানোর মধ্য দিয়ে। প্রতিযোগিতা চলে কয়েক পর্বে, চূড়ান্ত পর্বে যিনি বিজয়ী হন তাকে সে বছরে ‘বলী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। খেলা শেষে বিজয়ীকে মাথায় নিয়ে তার সমর্থকরা ঢোল বাজিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়। বর্তমানে এই খেলায় যুবকরাও অংশ নিয়ে থাকে। বর্তমানে ‘বলী’ খেলা এতটাই জনপ্রিয় যে, খেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা। মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পণ্য বিক্রয়কারীরা আগমন করে থাকেন।

চট্টগ্রামের অধিবাসীরা প্রতিবছর জব্বারের ‘বলী’ খেলা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ এই ‘বলী’ খেলা বা কুস্তি খেলা দেখে তারা খুবই আনন্দ পান। এটা চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি বিশেষ বিনোদন। জব্বারের বলী খেলা এখন চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। শত বছরের এই ঐতিহ্য লালনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যেন এ অঞ্চলের লোক-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হিসেবে জব্বারের বলী খেলা যুগ যুগ টিকে থাকে।

 

আলতাফ হোসেন

সমাজকর্মী

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads