• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

গণপরিবহনে নারী নিরাপত্তা

  • প্রকাশিত ২০ এপ্রিল ২০১৮

বর্তমান সময়ে নিরাপত্তাহীনতা আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আর এই সমস্যার প্রধান একটা বিষয় হলো পরিবহন খাত। কথায় কথায় আমরা নারী অধিকার, নারী আন্দোলন, নারীর অগ্রযাত্রা, নারীর আলোর পথের কথা বলি। কিন্তু এই আলোর আড়ালে কতটা অন্ধকার তা অনেকেই জানে। আর জেনেও কিছুই যেন কারো করার নেই। আমাদের সমাজে পরিবারে অফিস-আদালতে প্রতিযোগিতা হয়, অথচ কোথায় আছে মেয়েদের নিরাপত্তা? কে ভাবে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে? তবে কি নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নারীরা হাতে তুলে নেবে ঘরোয়া অস্ত্র, যা দিয়ে সে নিজের নিরাপত্তা বজায় রাখবে।

১.

আমার বড় সন্তান রৌদ্র সিএ পড়ে, সিএ ক্লাস শেষ হয় রাত ৯টা ১৫ মিনিটে, এরপর বাসায় আসা। মাঝেমধ্যেই ছুটির সময় আমি বের হয়ে ওকে নিয়ে আসি। নিজের অসুস্থ থাকার জন্য সেদিন যাওয়া হয়নি। ও আমায় কল করে বের হতে বলে, আমি বের হই, ও ইশারায় আমায় জানিয়ে দেয় পেছনের লোকটা ওকে ফলো করে, আমি লোকটার মুখোমুখি হই, সে অস্বীকার করে। পরিস্থিতিতে পড়ে সে স্বীকার করে। লোকটার ছবি ভিজিটিং কার্ড রেখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রতিদিন আমি ওকে আনার জন্য বের হতাম, হাতে ৫-৭ ইঞ্চি মোটা লোহার তারকাঁটার মতো একটা কিছু নিয়ে যেতাম। মনের মধ্যে একটাই ভাবনা ছিল, যদি কেউ ফলো করে বা পথে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হয় তাহলে যেন এটা দিয়ে আঘাত করতে পারি। আমার প্রশ্ন হলো— সন্তানের নিরাপত্তা দিতে, সন্তানের যাত্রাপথ সুগম করতে আমি বের হচ্ছি, কিন্তু আমার নিরাপত্তা কোথায়?

২.

গত ১৩ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার বিকালে সাভার যাব বলে আমরা বাসা থেকে বের হই। মূলত মায়ের সঙ্গে বৈশাখের দিনটি কাটাব সেই উদ্দেশ্যে। নিজেদের গাড়ি সমস্যা থাকায় গাড়ি ভাড়া নিতে চাই, কিন্তু ভাড়া গাড়ি না পেয়ে বাসে যাব বলে ঠিক করি। ফার্মগেট থেকে আমরা উঠি। ড্রাইভারের ব্যবহার খুবই খারাপ থাকে। সামনে-পেছনে সাভারের আরো ২-৩টা বাস থাকায় খুব খারাপভাবে প্রতিযোগিতা করে চালায়। কয়েকবার নিষেধ করি, সে বলে, এটা কোনো ব্যাপার না।

যাত্রী নামছে, উঠছে। অধিকাংশ যাত্রী নেমে যায় সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে। আমরা নামব রেডিও কলোনিতে, মানে সামনের স্টপেজে। বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস সামনে এগোচ্ছে, আমরা মিনিট দুই পরেই নামব। বাসের যাত্রী আমরা চারজন, পেছনে দুই লোক। হঠাৎ চোখ পড়ে সামনের থেকে ৪/৫ নম্বর সিটে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমার মনে হলো ২ মিনিট পর আমরা নেমে যাব পেছনের দুই লোক নেমে গেলে বাসের যাত্রী শুধু ওই মেয়েটা। মেয়েটা কখন ঘুমিয়েছে বা কই নামবে কিছুই জানি না। দেখে মনে হলো হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নয়তো চাকরিজীবী হবে। বোরকা হেজাব পরা। মেয়েটাকে ডেকে তুলি। মেয়েটি জানালো সে বিশমাইল যাবে। মেয়েটিকে আমাদের সঙ্গেই নামতে বলি। হয়তো পেছনের লোক দুজনও নেমে যাবে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল বিশমাইল আরো দেড়-দুই কিলোমিটার। তখন মেয়েটাকে আমাদের সঙ্গেই নামিয়ে নিয়ে আসি।

রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি বিশমাইল যাওয়ার কথা। সে বলে, রিকশায় যাওয়া ঝুঁকি হবে, বাসেই যাওয়া ভালো। পরে অন্য বাস ধরে মেয়েটা চলে যায় নিজের গন্তব্যে। আমরাও মায়ের বাসায়। প্রশ্ন হলো— কবে আমাদের সন্তানরা নিশ্চিন্তে বাসে উঠতে পারবে, নিজের গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে?

৩.

ঘটনাটি ১৫ এপ্রিল ২০১৮, রোববার। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ছাত্রীর লোমহর্ষক জবানবন্দি এটি। সাহস আর একটি স্টিলের টিফিন বক্স যেভাবে তাকে বাঁচিয়ে দিল। মেয়েটির জবানিতে শোনা যাক ঘটনাটি—

‘একটা স্টিলের টিফিন বক্স আজকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আব্দুল্লাহপুর থেকে রামপুরা আসার জন্য বাসে উঠেছিলাম সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। বাসে দুজন কন্ডাক্টরের একজন মনে হয় ড্রিংক করেছিল। অনেক ভিড় ছিল, তবে রামপুরা আসতে আসতে প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। পেছনের দিকে কয়েকজন ছেলে বসেছিল আর সামনের দিকে আমি আর আম্মু। বাসের লাইটগুলো বনশ্রীতে এসে বন্ধ করে দেয় ড্রাইভার, বলে যে তার হেডলাইট নষ্ট এজন্য বন্ধ করেছে। কালকে (সোমবার) সকালে পরীক্ষা, হাতে সময় নেই বলে কেউ এটা নিয়ে ঝামেলা করিনি। রামপুরায় পৌঁছে গেলে বাস জ‍্যামে পড়ে আর আমরা নামার জন্য দরজার দিকে যেতে থাকি। আম্মু প্রথমে নামে। আমি দরজা পর্যন্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন আমার হাত চেপে ধরে, আম্মু ততক্ষণে নেমে গেছে। আমি নামার চেষ্টা করি কিন্তু বাস সামনের দিকে যেতে থাকে আর পেছনে কয়েকজন বলছিল— ‘মাইয়াটা রে ধর’।

কী করব বোঝার মতো সময় ছিল না। অন্য হাতে একটা স্টিলের টিফিন বক্স ছিল ওইটা দিয়ে লোকটাকে বাড়ি মারলাম। কতটা লেগেছিল জানি না, কিন্তু আমাকে ধরে রাখা হাতটার শক্তি কমে গেল। ধাক্কা দিলাম লোকটাকে, বাস থেকে লাফ দিলাম। আমার ভাগ্য ভালো ছিল যে বাস আস্তে যাচ্ছিল আর মধুবনের সামনে জ‍্যাম ছিল। নেমে পেছনে দৌড় দিলাম। দূর থেকে আম্মুকে দেখতে পেলাম, আমাকেই খুঁজছে। জানতাম যে রাস্তায় একা বের হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে আজকে জানলাম মায়ের সঙ্গে বের হয়েও আমি নিরাপদ না। কালকের খবরের কাগজে আমিও হয়তো একটা কলাম হয়ে যেতাম— আমার রক্ত-মাংসের শরীরটার জন্য, কিছু জানোয়ারের জন্য। নিজ দেশে একটা মেয়ে তার মায়ের সঙ্গেও সুরক্ষিত নয়! আমাদের পূর্বপুরুষরা রক্ত দিয়ে এই স্বাধীন দেশ তো চায়নি। স্বাধীন দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা থাকতে হবে সর্বত্র। নাকি আমাদেরই অস্ত্র হাতে নিয়ে চলতে হবে?

 

রহিমা আক্তার মৌ

সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads