• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : কাল্পনিক

মতামত

আনন্দ

  • প্রকাশিত ২১ এপ্রিল ২০১৮

মানুষ মাত্রই হাসিখুশি থাকতে চায়। এই থাকতে পারাটা তার আনন্দ। মূল লক্ষ্য হওয়ায় এর পেছনে সে তার মেধার সবটুকু দেয় ঢেলে। এর জন্য এমন সব কাজ করে, যা তার সুখ-শান্তি দেয় উধাও করে। হাসিখুশি বিদায় হয়ে মুখ হয়ে যায় গুমড়ো আর কপালে পড়ে ভাঁজ। এই রূপ বাহ্য। বাইরের এই বিরূপতা দিয়ে তার ভেতরটা বিচার করলে হবে মহা ভুল। মন তার আনন্দে কুলুকুলু করে। এরাই আনন্দের প্রকৃত ধারক। যারা সবসময় হা হা হি হি করে, কাতুকুতু দেওয়ার ভঙ্গি করলে হেসে কুটিকুটি হয় তারা সামান্য বিপদের ইঙ্গিত পেলে মুষড়ে পড়ে, কেউ কেউ কান্নায় বুক ভাসায়। আনন্দ তাই সমসত্ত্ব্ব নয়।

আনন্দ যে একেকজনের একেক রকম- সেটা পরখ করতে ঘরে ঘরে কিংবা হাটবাজারে অফিস-কাচারিতে যেতে হবে না। নিজ বাড়িতে বসে একটু খেয়াল করলে সেটা মিলে যাবে। মিলে যাবে ভোরে খবরের কাগজখানা হাতে পেলে। টিভি চ্যানেলগুলোর সুদীর্ঘ বিজ্ঞাপনসহ এবং শেষে খবর ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান এবং সিরিয়াস টক শোগুলোতেও বহু হাসি ও তামাশার খোরাক মেলে। মেলে বলেই তো মানুষ কাগজ রাখে এবং টিভির রিমোট ঘোরায়।

এই আনন্দে লুকিয়ে থাকে কান্নাও। এ কারণে বাংলা বাক-রীতিতে সৃষ্টি হয়েছে ‘হরিষে বিষাদ’ শব্দবন্ধ। হওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তব কারণও রয়েছে। চারদিকে বা এদিক-ওদিক তাকালে তার দেখা মেলে। রোগে স্বাস্থ্যসেবা ঠিক মতো না নিতে পারায় (মূল কারণ অর্থাভাব) মাঝ-বয়সী ও তার কাছাকাছি বয়সের পরিবার-প্রধান হঠাৎ অক্কা পান। মৃত্যু হলেও তিনি যান বেঁচে। সংসার শুরুর আগে এবং শুরুতে অধিকাংশ পরিবার-প্রধান বুঝে উঠতে পারেন না কত বড় ঝক্কির মধ্যে তাকে পড়তে যেতে হচ্ছে। নিত্য অভাবের সংসারে যে ব্যক্তি সাবালকত্ব পাড়ি দিয়ে যৌবনে পৌঁছে, সেও বিয়ে করে সংসার শুরু করতে থাকে উদ্গ্রীব। কারণ আর কিছু নয় জৈবধর্ম। এ সময়টা এমন মারাত্মক যে, ছেলে এবং মেয়ে, ঠিক বললে নারী এবং পুরুষ, একে অপরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। তখন তারা জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তৎপর হয়। তারা নিজেরা নির্বাচন করলে এবং পরস্পর মেলামেশা আরম্ভ করলে সাধারণভাবে অভিভাবকরা জিনিসটা ভালো চোখে দেখেন না। তারা এটাকে অনৈতিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে গর্হিত মনে করেন। তারা এই মিশনে বাধা দেন। যুবক-যুবতীর স্বাধীনভাবে সঙ্গী নির্বাচন, যাকে বলা হয় প্রেম, আমাদের সমাজে বহুকাল আগে থেকে নিষিদ্ধ। ফলে এ দেশে সকল বাধা পেরিয়ে মিলন অথবা পেরুতে না পেরে আত্মহনন বহুকাল ধরে চলে আসছে। বর্তমান সময়ে ছেলেমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একত্রে পড়াশোনা করায় নারী-পুরুষের মেলামেশা যথেষ্ট সহজ হয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘প্রেম’ আজও সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। অর্থাৎ সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা বেড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক হওয়ায় এবং শিশু বয়স থেকে যৌবন পর্যন্ত ছেলেমেয়ের একসঙ্গে লেখাপড়া করার সুযোগ থাকায়, তারা এ সময়ের মধ্যে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। টিভিতে বিদেশি ছায়াছবি দেখেও বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়ে তাদের অনুকরণে চলাফেরা করে। ফলে এর দ্বারা নারী-পুরুষের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ছেলেমেয়ে একত্রে চলাফেরা করলেই যে তাদের মধ্যে প্রেম গজাবে, এমন নয়। তবে গজাবে না এমনও নয়। গজালে ছেলেমেয়ে এক ধর্মের না হলে সমস্যা হতে পারে। গার্জেনরা এ পরিস্থিতি সামলান অসম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে। বাল্যবিয়ের এটাই কারণ।

কৈশোর ও যৌবনে ছেলেমেয়ে কেমন আচরণ করবে তা নির্ভর করে বাবা-মায়ের ওপর। তারা যেমন, তাদের সন্তানও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হবে তেমন। তারা সংযত ও দায়িত্বশীল হলে ছেলেমেয়েও তেমন হবে। হালে বখাটেদের দ্বারা ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যা বেড়ে গেছে। বখাটেরা সাধারণত বখাটে পিতার সন্তান। ইমাম খোমেনি ইসলামী বিপ্লবের পর বখাটেদের দ্বারা ধর্ষণ ও খুন বন্ধ করেছিলেন তাদের ধরে ধরে প্রকাশ্যে জনতার উপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ইরানে ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বর্তমানে ইতিহাসের অন্তর্গত। তথাকথিত ব্যক্তি-স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার নামে যুক্তরাষ্ট্র ভাড়াটেদের দিয়ে বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে ইরান সরকার কঠোরহস্তে তা দমন করে তাদের দুষ্ট পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।

ফৌজদারি অপরাধ বিশেষত খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি প্রভৃতি বাড়ে আর্থ-ব্যবস্থার কারণে। মুক্তবাজার অর্থনীতি একটি দেশের আর্থ-ব্যবস্থা হলে সে দেশ যত ধনীই হোক সে দেশে ফৌজদারি যাবতীয় ঘৃণ্য অপরাধ থাকবে এবং বাড়বে। ঠেকানো যাবে না। পাশ্চাত্যের ‘উন্নত’ অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রতি ঘণ্টায় যত অপরাধ হয়- বাংলাদেশে, উদাহরণস্বরূপ, তার একভাগও বছরে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধের খবর সে দেশের সংবাদমাধ্যমে আসে না। এলে হাজার পাতার কাগজেও তা কুলোতো না। বাংলাদেশ নিম্ন আয় থেকে ‘উন্নয়নশীল’ স্তরে পদার্পণ করেছে। শেখ হাসিনা বলেন বলে নয়, জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক থেকে লিখিত সার্টিফিকেট পাঠিয়ে এ কথা বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। সে সার্টিফিকেটের বাঁধাই করা ছবি কাগজে প্রকাশ করা হয়েছে। ছবিতে দেখা গেছে, মাননীয় অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বাঁধাই করা সার্টিফিকেটটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। এটাও একটা ষড়যন্ত্র কিনা কে জানে? কারণ এ ঘটনার পর পর দেখা গেল, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কমেছে ২.৬ শতাংশ!

অন্যান্য পলিটিশিয়ানদের থেকে শেখ হাসিনার বৈশিষ্ট্য বা শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে, তার আছে ভিশন বা দূরদৃষ্টি। তিনিই প্রথম দেশবাসীকে আশার এই বাণী শুনিয়েছেন যে, বাংলাদেশ এ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে উচ্চ আয়ের অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির একটি রাষ্ট্র হবে। এ রকম কথা আগে কোনো বড় নেতা বলেননি। এটা মাথাপিছু আয়ের অঙ্কে। মাথাপিছু আয় বাংলাদেশে দ্রুত বাড়ছে। অনেকটা হাওরে অতিবৃষ্টি হলে যেমনটা হয়। গত বছর অতিবৃষ্টিতে হাওরের সব ফসল বিনষ্ট হয়। আল্লাহর রহমতে এ বছর তা হয়নি। এ বছর হাওরে উপচে পড়ছে ধান। গত বছরের লোকসান পুষিয়ে গেছে।

উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুরে হতো মঙ্গা। না খেয়ে মানুষ মরত। আধুনিক চাষাবাদের কৌশল আয়ত্তের পর মঙ্গা কেটে সেখানেও ফসলের বন্যা বইছে। চতুর্দিকের এসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে আশা করা অসঙ্গত হবে না যে, বাংলাদেশ শেখ হাসিনার কর্মতৎপরতায় চল্লিশ দশকের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হবে।

কিন্তু যে কথা দিয়ে লেখা আরম্ভ- এ শতকের চল্লিশের দশকে পৌঁছে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের মতো মাথাপিছু উচ্চ আয়ের দেশ হলে এখন দরিদ্রাবস্থায় বাংলাদেশে যেটুকু আনন্দ মানুষের আছে, তা থাকবে কিনা। দারিদ্র্যের মধ্যেও বিদেশিরা বলেন, বাঙালির মুখে হাসি সব সময় লেগে থাকে। তবে সব বাঙালির মুখে নয়। যারা বিত্তবান ও টাকার পেছনে দিবারাত্র ছোটেন তাদের মুখ থাকে গোমড়া। কোটি টাকা থলেতে অর্থাৎ ব্রিফকেসে এলেও তাদের মুখে থাকে না হাসি। না থাকার কারণ আরো এলো না কেন? অতি প্রাপ্তি আনন্দ ধ্বংস করে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন কালবোশেখির গতিতে হচ্ছে। এমনও হতে পারে চল্লিশের দশক পর্যন্ত কুঞ্চিত কপালে আজকের অভাগাদের নাও অপেক্ষা করতে হতে পারে। খুন-খারাবি ধর্ষণ যে গতিতে বাড়ছে, বাড়ছে ডাকাতি-ছিনতাই- সেটা বিবেচনায় নিলে তা-ই মনে হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির সেটাই ধারা। সেখানে আয় আর অপরাধ হাত ধরাধরি করে চলে। অপরাধ ছাড়া জীবনমান বাড়ে কেবল সমাজতন্ত্রে, যার সম্ভাবনা আপাতত নেই। স্থায়ী আনন্দের আভাসও তাই নেই।

লেখক : আবদুল মতিন খান

১৭.০৪.২০১৮

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads