• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

অপচয়ের এই সংস্কৃতি

  • প্রকাশিত ২১ এপ্রিল ২০১৮

২০০৭ সালে একটি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এক প্রকৌশলী, যিনি সাবেক পূর্ব জার্মানি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। বক্তব্য প্রদানকালে তিনি পূর্ব জার্মানির একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। পূর্ব জার্মানির অধিবাসীরা কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ, সেখানে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব কাজেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। যে কারণে কাপড় ধোলাই থেকে শুরু করে চুলকাটার মতো কর্মে যারা নিয়োজিত, তাদের ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়। একদিনের ঘটনা, বাংলাদেশি এই প্রকৌশলী সকালে খাওয়া-দাওয়া সেরে দ্রুত ক্লাসে চলে যান। দুপুরে তিনি যখন খাবারের জন্য কক্ষে ফেরেন, তখন দেখতে পান তার রান্নার প্রকৌশলী (বাবুর্চি) ষাটোর্ধ্ব মহিলা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৌশলী ফিরে আসামাত্র খাবার দেওয়া তো দূরের কথা, চোখ রাঙিয়ে তাকে বললেন, ‘তুমি আমার দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছ, আমি তোমাকে আর রান্না করে খাওয়াব না।’ মহিলা এই বলে তার রান্নাঘরের চাবি হস্তান্তর করেন। এবার বাংলাদেশি এই প্রকৌশলীর কী হয়েছে, জানতে চাইলে, তাকে জানান, ‘তুমি কেন অপ্রয়োজনে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিলে।’ সবিশেষ প্রকৌশলী ওই মহিলার কাছে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন। তার এই অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে বাকি থাকে না, একজন সাধারণ মানুষ কতটুকু দেশপ্রেমিক হলে এ ধরনের আচরণ মালিকের সঙ্গে করতে পারেন। অথচ আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছি, তাতে করে আমাদের দেশপ্রেমের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুৎ এলে সব সুইচ অন করে ক্ষতিপূরণের সংস্কৃতি আমরা অহরহ দেখছি। পানির ট্যাপ ছেড়ে রাখা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি জাপান ফেরত একজনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। তিনি জানালেন, ওই দেশে কর্মছাড়া অর্থাৎ কোনো মানুষই বেকার নয়। তাদের অর্থের অভাবও নেই। সরকারের ট্যাক্স পরিশোধ করার জন্য ওই দেশের অধিবাসীরা অস্থির হয়ে পড়েন। ব্যবসায়ীরা সারাদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষে রাষ্ট্রের পাওনা ট্যাক্স তাৎক্ষণিক পরিশোধ করেন। দোকানদাররা বাকিতে পণ্য বিক্রি করেন ঠিকই, তবে সরকারি ভ্যাট ক্রেতার কাছ থেকে তাৎক্ষণিক রেখে দেন। ফলে সরকারের কোষাগার সবসময় পূর্ণ থাকে। রাষ্ট্রের সব ব্যয়ভার বহন শেষে ওই দেশের সরকার পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা দেন। অপূর্ব!

যতদূর জানি, বাংলাদেশ সরকারকে ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মোট তিন বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। সরকার থেকে সেবা পেতে চাই, তবে দিতে চাই না। সরকার, রাষ্ট্রের আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নয় এবং জনবিচ্ছিন্ন কোনো ভূখণ্ডও নয়; রাষ্ট্র, সরকার সমষ্টিগত জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ। যার চূড়ান্ত ফলাফলে পৌঁছতে হলে সমন্বিত সহযোগিতার বিকল্প নেই। বিনা টিকেটে ট্রেনভ্রমণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, সরকারি জায়গাজমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থপাচার ও সরকারি সম্পদ এবং অর্থ আত্মসাতের মতো অপরাধ অহরহ হচ্ছে। নানা ধরনের মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ আমাদের ঘিরে রেখেছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন নেই। মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই আমরাও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে শুধু সমসাময়িক পর্যায়ে নয়, একেবারে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পারব। জাতির নানা কলঙ্ক মোচন করাও সম্ভব। এজন্য আইন-আদালত নয়, বিবেকের রক্তক্ষরণ প্রয়োজন।

অপচয় ব্যক্তি, মানুষকে অভাবী করে। অপচয়কারীরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়। অপচয় পৃথিবীর কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। একটি জাতির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান শর্ত স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে শামিল হওয়া।

গত ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কুষ্টিয়া ভেড়ামারার ৪১০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ আমাদের মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবার সচেতন ও মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। আমি যখন ঘর থেকে বের হই, নিজের হাতে সুইচ বন্ধ করি। এতে আমার সম্মান যায় না, নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে সম্মান হানির কিছু নেই। আপনারা যখন ঘর থেকে বের হবেন, তখনই সুইচ বন্ধ করে যান। আপনারা যদি সুইচ বন্ধ করে রাখেন তাতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। এতে আপনাদেরই উপকার হবে। দেখবেন মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল কম আসছে। এক ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হয়, আমরা আপনাদের কাছ থেকে সে দাম নিই না। বিদ্যুৎ খাতে আমরা ভর্তুকি দিই। অনেক কম দামে আপনারা বিদ্যুৎ পান।’ প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের সচেতন হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তার এই আহ্বানকে ঘিরে আমরা মিতব্যয়ী হওয়ার সংস্কৃতির অনুশীলন অবশ্যই করতে পারি।

 

রহিম আবদুর রহিম

লেখক : নাট্যকার ও শিক্ষক

rahimabdurrahim@hotmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads