• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগ

  • প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০১৮

ব্লাস্ট ধানের একটি ছত্রাকজনিত মারাত্মক ক্ষতিকারক রোগ। পাইরিকুলারিয়া ওরাইজি নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়ায় রোগটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। রোগপ্রবণ জাতের ধানে রোগ সংক্রমণ হলে ফলন শতভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

বোরো মৌসুমে ব্লাস্ট রোগ বেশি হয়। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় এ রোগ দেখা যায়। এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং নেক বা শিষে আক্রমণ করে থাকে। তাই এ রোগটি পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও নেক বা শিষ ব্লাস্ট নামে পরিচিত। এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং নেক বা শিষে আক্রমণ করে থাকে। তাই এ রোগটি পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও নেক বা শিষ ব্লাস্ট নামে পরিচিতি। এ রোগ বীজের মাধ্যমে এক মৌসুম থেকে অন্য মৌসুমে ছড়ায়। এ ছাড়া ব্লাস্ট রোগের জীবাণু বাতাস ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর জীবাণু দ্বারা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সতেজ ধান গাছ আক্রান্ত হয়। আর যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পায় সেখানেই জীবাণু ধান গাছের উপর পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।

গত দু’বছর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশে বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ দেখা দেয়। বিশেষ করে, ব্রি-২৮ জাতের বোরো ধানে এ রোগের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ফলন ও গুণগতমান বিবেচনায় স্বল্প জীবনকালের ধানের এ জাতটি কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ও সমাদৃত। এক তথ্যে জানা যায়, বোরো মৌসুমে দেশের আবাদি ৪১ ভাগ জমিতে এবং আউশ মৌসুমে ২৯ ভাগ জমিতে ব্রি-২৮-এর চাষ হয়। বোরো মৌসুমে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান সম্মিলিতভাবে ৬৫-৬৭ ভাগ জমিতে চাষ হয়। ব্রি-২৮ ছাড়াও এ বছর বিআর-২৬, ব্রি-২৯, ব্রি-৫০, ব্রি-৬১ ও ব্রি-৬৩সহ অন্যান্য জাতের ধানেও ব্লাস্টের সংক্রমণ ঘটেছে। অন্যদিকে হাইব্রিড জাতের ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায়। আগে সাধারণত ধানে পাতা ব্লাস্টের প্রকোপ বেশি দেখা গেলেও এ বছর শিষ ব্লাস্টের আক্রমণ ছিল সর্বাধিক। কোথাও কোথাও আবার নোড বা গিঁট ব্লাস্টের ব্যাপক আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। তবে উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধানের মধ্যে ব্রি-৫৮, ব্রি-৬৭ ও ব্রি-৬৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এ ছাড়া যেসব কৃষক ভাই রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধান গাছে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেছেন তাদের জমির ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ কম হয়েছে।

পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও  শিষ ব্লাস্ট— এই তিন ধরনের ব্লাস্ট রোগের মধ্যে নেক বা শিষ ব্লাস্ট ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ রোগের অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় গত দু’বছর ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। দিনের বেলায় গরম (২৫০-২৮০ সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠান্ডা (২০০-২২০ সেন্টিগ্রেড), শিশিরে ভেজা দীর্ঘ সকাল, অধিক আর্দ্রতা (৮৫% বা তার অধিক), মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, আগাম বৃষ্টিপাত, ঝড়ো আবহাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ধানের জমি শুকনো থাকা, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে পটাশ সার দেওয়ার কারণে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে।

এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রতিরোধক্ষম জাতের বোরো ধান যেমন- ব্রি-৫৮, ব্রি-৬৭ ও ব্রি-৬৯-এর চাষ করতে হবে। এসব জাতের ধানে এখনো ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি; মাটিতে পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করা উচিত নয়। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পটাশ সার সমান দুই ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ভাগ জমি তৈরির সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় ব্যবহার করতে হবে; আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ না করে সুস্থ এবং রোগমুক্ত জমির ধানগাছ থেকে বীজ সংগ্রহপূর্বক শোধন করে ব্যবহার করতে হবে; ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত জমির ধান কাটার পর, খড়-কুটো পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে; এবং প্রয়োজন বোধে ধানের জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে ১-২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। ধানের কুশি অবস্থায় পাড়া ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া ব্লাস্ট আক্রান্ত ধানের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সর্বোপরি, ধান গাছে ব্লাস্ট রোগ দেখামাত্র ট্রুপার-৭৫ ডব্লিউপি, নাটিভো-৭৫ ডব্লিউজি, ব্লাস্টটিন-৭০ ডব্লিউজি, ফিলিয়া-৫২৫ এসই জাতীয় ছত্রাকনাশক ৬ গ্রাম-২০ গ্রাম অর্থাৎ অনুমোদিত মাত্রায় শেষ বিকালে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ক্যালোরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে ভাত থেকে। এ দেশের জমি ও আবহাওয়া ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশের বিভিন্ন মৌসুমে আবহমানকাল থেকে এ ফসলের চাষ হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় ধান ফসলে ব্লাস্টসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে। তাই ধানের এসব ক্ষতিকর রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত আবশ্যক।

 

মো. আবদুর রহমান

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads