• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বড় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে লাভ হবে

  • আবু আহমেদ
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৮

বিচ্ছিন্ন থেকে উন্নয়ন করার দিন শেষ হয়ে গেছে। অন্য দেশের পণ্যের জন্য ট্যারিফ ওয়াল নির্মাণ করে এখন কোনো অর্থনীতিই এগোতে পারবে না। সবকিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ধারণা অনেক পুরনো এবং ওই ধারণা বিশ্বের অন্য দেশগুলো অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। গত দুই যুগ যাবৎ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিশ্বায়ন ঘটেছে, তা এক অর্থে বিপ্লবাত্মক। বিভিন্ন বহুজাতীয় ট্রেড নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্য এখন অনেকটা বাধাহীন। এই লক্ষ্যে জাতিসমূহ সর্বক্ষেত্রে নেগোসিয়েশন রাউন্ড (Round) হিসেবে গ্রহণ করেছিল দোহা রাউন্ডকে (Doha Round)। দুঃখজনক হলো, বড় অর্থনীতিগুলোর অনীহার কারণে দোহা রাউন্ডের সফল সমাপ্তি ঘটেনি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উদারীকরণের ক্ষেত্রে দোহা রাউন্ড আর এগোবে বলে মনে হয় না। তবে গ্লোবাল বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উদারীকরণের গতি শ্লথ হয়ে গেলেও থেমে যায়নি। বিশ্বের দেশগুলো তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ভিত্তিতে আলোচনা ও চুক্তি করে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (Free Trade Agreements-FTAs) এবং মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল (Free Economic Unions) গঠন করে নিচ্ছে। একসময় বিশ্বের এক নম্বরের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উদারীকরণে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু তারা এখন অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তারা  'American First'- এই স্লোগানের আড়ালে প্রকারান্তরে একধরনের সংরক্ষণবাদের (Protectionism) নীতি গ্রহণ করেছে। যে চুক্তি তারা ইতোপূর্বে সই করেছে, সেই চুক্তি থেকেও সরে এসেছে। উদাহরণ হলো- ১২ দেশের TPP (Trans Pacific Partnership) চুক্তি। যে ১২টি দেশ এই চুক্তিতে সই করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল- অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চিলি, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে সই করা TPP চুক্তি থেকে সরে আসে। অবশ্য অন্য ১১টি দেশ TPP চুক্তিতে থাকার পক্ষে অবস্থান নেয় এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই নতুন করে TPP চুক্তি সই করে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে অনেক দূর এগিয়ে যায়। কিন্তু সেই অবস্থান থেকেও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে সরে এসেছে। অন্যদিকে WTO (World Trade Organization)-এর অধীনে এতদিন থেকে চলে আসা দোহা রাউন্ড অনেকটাই পরিত্যক্ত। ছোট অর্থনীতিগুলোর যেহেতু দরকষাকষির শক্তি খুবই দুর্বল, তাদের জন্য WTO-এর নেতৃত্বে দোহা রাউন্ড ছিল কাঙ্ক্ষিত একটি আলোচনা। এখন বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতিগুলোর সামনে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরো উদারীকরণ হবে- এমন আশা আর নেই।

ছোট অর্থনীতিগুলো এখন নিজেদের বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে অথবা যেসব অর্থনীতি তাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধা দিতে পারে- এমন অর্থনীতিগুলোর মধ্যে FTAs এবং FEUs (Free Economic Unions) গঠন করে নিচ্ছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ একসঙ্গে চলে। যেসব অর্থনীতি বেশি বিনিয়োগ লাভ করেছে, ওইসব অর্থনীতির বাণিজ্য অনেক বেড়েছে। উদাহরণ হলো ভিয়েতনাম। একসময় ভিয়েতনাম সমাজতন্ত্রের নামে বদ্ধ (Closed) অর্থনীতি ছিল। যখন থেকে তারা বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করল তারপর থেকে ভিয়েতনামে বৈদেশিক বিনিয়োগ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভিয়েতনামের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক আগেই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে। সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম এখন নতুন এশিয়ান টাইগারদের তালিকায় এসে গেছে। ভিয়েতনাম এক ডজনেরও বেশি FTAs সই করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের সফলতা শূন্য। বাংলাদেশ তার বাস্তবতা থেকে বের হতে পারেনি। মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা FTAs নিয়ে বাংলাদেশও অনেক কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো দেশের সঙ্গেই FTA সই করতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্য ভালো সুযোগ ছিল SAFTA (SAARC Free Trade Agreement)। কিন্তু সত্য হলো, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কারণে SAFTA বা কমের পক্ষে SAPTA (SAARC Prefarential Trade Agreement)-কেও কার্যকর করা যায়নি। এর বদলে মাঝেমধ্যে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানকে নিয়ে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন করার অনেক কথা শুনেছি। অন্যদিকে ভারত-চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ মিলেও একটা সীমিত আকারে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করার কথা শুনেছি। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই কাজ এগোয়নি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম পার্টনার। প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে এই দুই দেশের মধ্যে প্রতিবছর। তবে এই ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের রফতানি চীনের বাজারে অতি নগণ্য। বাংলাদেশ বিক্রয় করে এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাকিটা চীন বিক্রি করে আমাদের কাছে। ভারতের সঙ্গেও আমাদের একই অবস্থা। ভারত বিক্রি করে ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, বাংলাদেশ বিক্রি করে ভারতের কাছে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। চীন-ভারত বাংলাদেশকে অনেক বাণিজ্য সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ এই দুটো বাজারে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণের পণ্য বেচতে সক্ষম হচ্ছে না। বাংলাদেশের পক্ষে তার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই সিদ্ধান্ত নিতে যেন কঠিন হচ্ছে। কোন সুবিধা বাংলাদেশ চীনকে দিলে পরে ভারত রুষ্ট হয় এই চিন্তা আমাদের পলিসি মেকারদের যেন পিছু টেনে ধরেছে। কোনটা আমাদের সুবিধা, এই চিন্তাই যেন পিছনে পড়ে গেছে।

বাস্তবতা হলো চীন বাংলাদেশে যেটা দিতে পারবে ভারত সেটা দিতে পারবে না। এখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। শত শত বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। চীন এক অর্থে আমাদের অনেক নিকটের। চীনের সাহায্য ও বিনিয়োগ যে অর্থনীতিকে মৃত্যুর পথ থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারে, তার উদাহরণ হলো পাকিস্তান। পাকিস্তান এতদিনে দেউলিয়া অবস্থায় চলে যেত। শুধু চৈনিক বিনিয়োগ তাদের সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। আজকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি (growth) হচ্ছে, তার ৩০% আসছে চীনের প্রবৃদ্ধি থেকে। মোট গ্লোবাল অর্থনীতির ১৫% মালিক হলো চীন। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে তারা হয়ে যাবে বিশ্বের এক নম্বরের অর্থনীতি। নেপাল-ভুটান-শ্রীলঙ্কা আমাদের বেশি বাণিজ্য দিতে পারবে না। পারবে চীন। ভারতও দিতে পারবে, তারা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে সেটা চায়। এখন বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে প্রচুর চীনা বিনিয়োগ প্রবাহিত হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পে তারা যেমন ঋণ দিচ্ছে, তেমনি বাস্তবায়নে ঠিকাদারির কাজটাও করছে। আমাদের ধারণা, চীন আরো দিতে চায়। শুধুই বাংলাদেশের ইতস্ততার কারণে সেই দেওয়াটা হয়ে উঠছে না। চীন তো মহেশখালীর সোনাদিয়ায় আমাদের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিল। আমরা ইতস্তত করলাম। পরে চীন ঠিকই মিয়ানমারের রাখাইনে নিজ উদ্যোগে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে নিল। এই ক্ষেত্রে কে হারল, বাংলাদেশ না চীন? যারা সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে আমরা তাদেরকে তা করতে দিচ্ছি না। আর যারা সক্ষমতা রাখে না, তাদের সঙ্গেই বাংলাদেশ যেন বেশি কথা বলে। চীন তো বাংলাদেশকে একটা FTA-এর প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে। কী অসুবিধা হবে আমরা যদি চীনের সঙ্গে একটা FTA সই করি? যেসব অসুবিধার কথা কোনো কোনো মহল বলছে ওইসব শুনলে এদেশের বাণিজ্য বাড়বে না, অর্থনীতিও বেশি বিনিয়োগ পাবে না। চীন আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে ভালোভাবে যুক্ত হতে পারলে অর্থনীতির উপরে সবার আস্থা বাড়বে। বিনিয়োগকারীরাই মনে করবে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পণ্য চীনের বাজারে বিক্রি করা যাবে। তখন বাংলাদেশ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের আর অভাব হবে না।

বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে দেখে বাজার, যে বাজারে তারা পণ্য বেচতে পারবে। চীনের সঙ্গে একটা FTA-তে বাংলাদেশ নিজকে যুক্ত করতে পারলে বাজারের সমস্যাটা আর থাকবে না। অন্য অনেক দেশ ইতোমধ্যে চীনসহ নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক চুক্তি করেছে। বাংলাদেশকে দেখতে হবে ভবিষ্যতের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রবাহ কোন দিক থেকে কোন দিকে যাবে। শুধু একটি পণ্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি করে আমরা রফতানিতে যে প্রবৃদ্ধি অর্জন এতদিন করে আসছিলাম তা ভবিষ্যতে অর্জন করা আর সম্ভব হবে না। এখন অর্থনৈতিক জোটের শরিকদের মধ্যেই বড় রকমের বাণিজ্যগুলো হবে। অন্য দেশগুলোর জন্য নির্মাণ করা হবে শুল্ক দেয়াল (Tariff Wall)। বাংলাদেশ কি শুল্ক দেয়ালের মধ্যে পড়ে থাকতে চায়!

লেখক : অর্থনীতিবিদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads