• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

প্রতীকী ছবি

মতামত

সমাধান কোন পথে

  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৮

সমস্যাটি সম্পর্কে সবাই জানেন। আলোচনাও বিস্তর। কিন্তু সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউই। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের অনিবার্য ফল হিসেবে দেশ আবার অরাজক পরিস্থিতির কবলে পড়ে কি না তা নিয়ে চিন্তিত কমবেশি সবাই। দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করার বিষয়টিকে সচেতন মহল খারাপ সঙ্কেত হিসেবেই দেখছে। তারা বলছে যে, এ প্রশ্নে যদি দেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক দুই বড় দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারো অতীতের দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও একটি বিষয়ে তাদের মনোভাব খুব কাছাকাছি। উভয় দলই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ তা শুরু করেছে প্রকাশ্যে ও আনুষ্ঠানিকভাবে। আর বিএনপি নেতারা মুখে যা-ই বলুন, ভেতরে ভেতরে তারাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। পত্র-পত্রিকার খবর অন্তত তাই বলে।

বিএনপির আগের দাবি ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের। এখন সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি। তারা সবাই একরকম এক বাক্যেই বলছেন যে, বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি দুটি। এক. দ্রুত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে, দুই. তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। এ দাবি পূরণ না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না- এমন কথা বিএনপির ছোট-বড় সব নেতাই বলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা সরকারের মন্ত্রীও- তারা বলছেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আর তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না তাও আইন-আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। এখানে সরকারের কিছুই বলার বা করার নেই।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ পূর্বাপর বলে আসছেন যে, একটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে দেশের সব রাজনৈতিক দলের তাতে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বিএনপি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলটিকে ম্রিয়মান বলে মনে হলেও জনসমর্থনের দিক থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

শাসক দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের মন্তব্য হলো, গত নয় বছরে সরকার উন্নয়নের যে গতি এনেছে, তাতে তাদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারের পারদ যে উচ্চতায় যাবার কথা ছিল তা হয়নি। এ জন্য তারা দলটির যুব ও ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু সংখ্যক নেতাকর্মীর কার্যকলাপকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন যে, গত নয় বছরে সরকারের সব অর্জন ছাত্র-যুবলীগের কার্যকলাপে চাপা পড়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, এ নিয়ে খোদ শাসক দলেও রয়েছে অসন্তোষ। এমনকি অতিষ্ঠ হয়ে দলের সাধারণ সম্পাদককেও মাঝেমধ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়।

বিএনপির অভিযোগ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি নিশ্চিত- এটা বুঝতে পেরেই বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টায় রত হয়েছে সরকার। যাতে ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। কারো কারো মতে, সরকার রাজনৈতিক দাবার চালে বিএনপিকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যেতে চায়, যেখান থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলটির পক্ষে আর সম্ভব না হয়।

এদিকে পত্র-পত্রিকায় দুই দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি ও কৌশলের খবর প্রতিনিয়তই বের হচ্ছে। আওয়ামী লীগ তাদের প্রস্তুতি বেশ জোরেশোরেই শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে জনসভা করেছেন, যেগুলোতে তিনি আগামী নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এসব জনসভার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছে। তারা বলছেন যে, তিনি সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে আগাম নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন, যা অনৈতিক এবং নির্বাচনী আইনের খেলাপ। তারা তাদের আপত্তির কথা নির্বাচন কমিশনকেও জানিয়েছেন।

অনেকের মনেই প্রশ্ন- শেষ পর্যন্ত হবে কী? বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নাকি আবারো ২০১৪ সালের মতো বর্জনের পথে হাঁটবে? আর বিএনপি যদি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত না-ই আসে, তাহলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান আক্ষরিক অর্থেই সম্ভব হবে কি না! গত ২০ এপ্রিলের বাংলাদেশের খবরের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ নির্বাচনে বিএনপির হাবভাব দেখেই আওয়ামী লীগ তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে। এ মুহূর্তে তারা দুটি বিকল্প পন্থা রেডি রাখছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে পরিকল্পনা হবে একরকম, আর বর্জন করলে আরেক রকম। আর সেভাবেই তারা শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন করবে।

এদিকে কিছু সংবাদমাধ্যমে খবর বেরুচ্ছে যে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে বিএনপিতে দ্বিধা-বিভক্তি ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ বেগম জিয়াকে ছাড়াই নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক। আর অপর অংশটি দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে কোনোভাবেই অংশ নিতে রাজি নয়। তারা এ মুহূর্তে নির্বাচনের চেয়ে চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলনকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। তা ছাড়া তারা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার প্রশ্নে অনড়। তাদের বক্তব্য হলো, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই যদি নির্বাচনে যেতে হয়, তাহলে ২০১৪ সালে কেন যাওয়া হলো না? ওই নির্বাচন বর্জন করে যে আন্দোলন করা হয়েছিল, তাতে যেসব নেতাকর্মী নিহত-আহত হয়েছে, জেল খেটেছে, তাদের সেই ত্যাগের কী মূল্য থাকল? বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী মনে করেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটির কোনো লাভ হবে না।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ সুগম করতে হবে। কারণ, বিএনপির মতো একটি বড় এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যাবে না। একই কথা বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। গত ২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির মতো বড় দল অংশ না নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। আমরা অগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ চাই।’ সিইসির সে বক্তব্য সর্বমহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, তিনি বাস্তবতাকে অনুধাবন করে সত্যিটা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নে ইসি আর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না এবং কোনো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার দায়িত্বও ইসির নয়। সিইসির সে বক্তব্য দেশবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে, অনেকে  বলছেন, সিইসি তার কথার মধ্যে একটু ফাঁক রেখেছেন। তিনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছেন। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলেননি। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে তা অংশগ্রহণমূলক হবে সন্দেহ নেই। তবে, তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে বলা মুশকিল। কেননা, বিএনপি অংশ নিলেই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ক্ষমতাসীন দল যদি প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিএনপির প্রার্থী ও কর্মীদের মাঠছাড়া করে দেয় কিংবা ভোটের দিন নিরাপত্তার অভাবে বিএনপি কর্মী-সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারেন, তাহলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কীভাবে? ফলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নির্বাচন শুধু অংশগ্রহণমূলক হলেই চলবে না, গ্রহণযোগ্যও হতে হবে।

এটা ঠিক, বিএনপি এখন চরম দুঃসময় পার করছে। চেয়ারপারসন কারাগারে, তার মুক্তি কবে মিলবে তা অনিশ্চিত। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান অবস্থান করছেন বিদেশে। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে আন্দোলন ও নির্বাচন প্রশ্নে। সরকার যদি সংবিধান অনুযায়ী তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে শেষ পর্যন্ত অনড় থাকে, তাহলে বিএনপি কী করবে তা বলা যাচ্ছে না। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এ প্রশ্নে আরেকবার ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বিএনপি। সরকার নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে বিএনপির একটি অংশকে প্রলুব্ধ করতে পারে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে। তবে সেগুলো সবই অনুমাননির্ভর।

উল্টোদিকে ক্ষমতাসীনরাও খুব একটা স্বস্তিতে আছে বলে মনে হয় না। টানা দশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পর পুনরায় জয়ী হওয়া যেমন তাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনি সে নির্বাচনকে অর্থবহ করে তোলাও তাদের বড় দায়। তারা এটা অন্তত উপলব্ধি করতে পারছেন যে, ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন দেশে কিংবা বিদেশে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচনে আসুক তারাও সেটা চান। আর এ জন্যই আওয়ামী লীগের নেতাদের অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে বলতে শোনা যায়, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে।

ক্ষমতাসীনদের এমন আশাবাদ দোষের কিছু নয়। বরং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো পারস্পরিক আস্থা রেখে চলবে এটাই কাম্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে রেখে নির্বাচনে যাবে? স্মরণযোগ্য, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সর্বশেষ সমাবেশে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে তার দল নির্বাচনে যাবে না। তিনি এখন কারাগারে। এ বিষয়ে তার মতামত সরাসরি জানার কোনো উপায় নেই।

অবশ্য এটা সত্যি যে, দেশের রাজনীতি এখন অনিশ্চিত পথের যাত্রী। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুই প্রধান দলের বিপরীতমুখী অবস্থানদৃষ্টে দেশবাসী শঙ্কিত। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।  দেশের সাধারণ মানুষ কোনো সংঘাত চান না। তারা একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ চান। আর জনগণের সে চাওয়া পূরণ করতে পারে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল— বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। তবে, সবই নির্ভর করছে শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছার ওপর। আর যদি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পরস্পরের দিকে পিঠ দেখিয়ে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে রাজনীতির গতিক কী হবে, বলা মুশকিল।

 

মহিউদ্দিন খান মোহন

লেখক : সাংবাদিক

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads