• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

প্রতীকী ছবি

মতামত

বেকার সমস্যা সমাধানে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৮

গত ৩১ মার্চ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমরো’স জবস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কলেজগুলো থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ৭০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং প্রতিবছর ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানে প্রবেশ করতে পারছে ৫ লাখের কিছু বেশি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রির্সাচ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে দেশে উচ্চশিক্ষিতদের (অনার্স-মাস্টার্স) মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এ হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কেন বেকারত্বের হার বাড়ছে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বাজার চাহিদার আলোকে প্রণীত হয়নি। যার কারণে শিক্ষিতজনদের শিক্ষা পাকস্থলীর নয়, গুদামজাত দ্রব্য হয়ে আছে। কিছু দেশ আছে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। আর কিছু দেশ আছে মানবসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোও যদি মানবসম্পদে উন্নতি করতে না পারে তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদের ফল ভোগ করতে পারে না। যেমন- নাইজেরিয়া তেল সমৃদ্ধ দেশ হয়েও মানবসম্পদের উন্নতি করতে না পারায় প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারছে না। আফ্রিকার কঙ্গো, সুদান, লাতিন আমেরিকা ব্রাজিল মানবসম্পদে উন্নত না হওয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও উন্নতি করতে পারেনি। এদিকে সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ের মতো দেশগুলো মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করছে। অন্যদিকে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। যে দেশগুলোতে প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই কিন্তু মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করেছে। ১৮৭৭ সালে জাপানের টোকিওতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হয়। ১৮৮০ সাল থেকে গ্র্যাজুয়েট বের হতে থাকে। এ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল ফিজিকস, কেমিস্ট্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। কারণ সে সময় জাপানে এ শাখায় জনবলের চাহিদা ছিল। তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় চাহিদার আলোকে প্রস্তুত করেছিল। তাই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল না হয়েও জাপান উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং শিক্ষার হার বাড়ালেই হবে না। জানতে হবে কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বড় ধরনের ফারাক আছে চাহিদাবিধির। বর্তমানে দেশের ৩০ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী কলা ও মানবিক শাখায় অধ্যয়নরত। তবে এ শাখার বাজার চাহিদা ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। তাহলে বাড়তি ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার সমস্যার কারণ হবে। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় চাহিদা ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ থাকলেও এ খাতে উৎপাদন ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বিজ্ঞান শাখায় চাহিদা ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, কিন্তু জোগান মাত্র ৮ শতাংশ। চিকিৎসাবিজ্ঞান শাখায় চাহিদা ১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে জোগান শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। জোগান ও চাহিদা বিধির এমন অসামঞ্জস্য বেকার সমস্যাকে আরো চাউর করছে। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও ব্যবসা শাখায় জনবল বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা আমাদের দেশে অনেকটাই অবহেলিত। যদিও সরকার আন্তরিকতা দেখাচ্ছে তথাপি সেটা অপ্রতুল। আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েট লেভেলে কারিগরি শিক্ষায় পাসের হার মাত্র ৩ শতাংশ, অবশ্য সরকার বলছে ১০ শতাংশ, কিন্তু এটি ভারতে ২৭ শতাংশ, নেপালে ২৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪০ শতাংশ এবং উন্নত দেশে ৬০ শতাংশের বেশি। চীনের ৫১ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। আর দেশেও যেমন এ শিক্ষার চাহিদা তেমনি দেশের বাইরেও অনেক বেশি। ইরাক, চীন, জাপান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ ইউরোপেও কারিগরি শিক্ষায় জনবলের চাহিদা রয়েছে। দেশের ভিতরেও কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা ক্রমে বাড়ছে। সুতরাং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন আনতে হবে তেমনি জোর দিতে হবে কারিগরি শিক্ষা খাতে।

২.

দেশে একটি অপার সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র, হালকা ও মাঝারি আকারের শিল্প-কারখানা। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বাইশিমাস) তথ্য মতে, সারা দেশে ৮৭ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র, হালকা ও মাঝারি শিল্প-কারখানা রয়েছে। ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে এ শিল্পে প্রতিবছর টার্নওভার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫০ কোটি টাকারও বেশি। মোট জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। এ খাতে ৩৫ লাখ কর্মীসহ দেড় কোটি মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের তৈরি প্লাস্টিকের খেলনা পৃথিবীর ৩৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। যার রফতানি আয় ১২৬ কোটি টাকা। অপার সম্ভাবনাময় এ খাতের ৯০ শতাংশই রুগ্ণভাবে চলছে। আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, চলতি মূলধন সঙ্কটসহ প্রশাসনে নানা উৎপীড়নে এ খাত সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এদেরকে স্বল্প পুঁজি দিয়ে স্বাবলম্বী করা, একই সঙ্গে স্বল্প পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব। আবার দেশের রফতানি আয় বৃৃৃৃৃৃদ্ধিও হবে। তাই এ খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

৩.

কারিগরি শিক্ষায় উন্নতি করা সম্ভব হলে দেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করা যাবে, তেমনি চাহিদার আলোকে দেশে ও বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদের জোগান দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব। অন্যদিকে দেশে ও বিদেশে ক্ষুদ্র, হালকা ও মাঝারি শিল্পের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে সে আলোকে এ খাতের উন্নয়ন করতে পারলে কর্মসংস্থানের অভাব পূরণ হবে, একই সঙ্গে সরকারের ঘাড়ে চাকরির ব্যবস্থা করার যে খড়্গ আছে সে চাপও কমবে এবং ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করবে। এ ছাড়াও বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেটা শুধু প্রধান শহরগুলো কেন্দ্রিক না করে বিকেন্দ্রীকরণ করলে অধিক ফলপ্রসূ হবে। তা না হলে আয় বৈষম্য আরো চরমে উঠবে, বাড়বে বেকার সমস্যা।

জি কে সাদিক

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads