• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

শেরেবাংলা একে ফজলুল হক

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

অবিভক্ত বাংলায় শেরেবাংলার অবদান

  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৮

অনগ্রসর মুসলিম সমাজ আলোকিত করার স্বপ্ন নিয়ে ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার সাতুরিয়া গ্রামে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৌলভী মো. ওয়াজেদ আলী।

শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের জন্মস্থান বরিশালে নানাবাড়ি। বাবা ওয়াজেদ আলী, পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৫৭ সালে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়াজেদ আলী মুসলিম বাংলার তৃতীয় গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বাকেরগঞ্জ জেলা বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যানও ছিলেন। হক সাহেবের মাতা সৈয়দুন্নেসা ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ও সম্মানিত মহিলা। ১৯২১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সম্পদ ও বিত্তশালী বাবার একমাত্র ছেলে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক অত্যন্ত প্রাচুর্য ও বিলাসের মধ্যে লালিত-পালিত হন। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়িতে। উপযুক্ত গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে বাড়িতেই তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন।

অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী একে ফজলুল হক বহু ভাষায় জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃতি, ইংরেজি, ল্যাটিন ও বাংলা ভাষায় অনর্গল নির্ভুল বক্তৃতা দিতে পারতেন। উল্লেখযোগ্য, ১৯৩৭ সালের ১৬ অক্টোবর নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক অধিবেশনের লক্ষেৗতে স্থানীয় উর্দু ভাষায় এক আবেগময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তারই ফলে সেখানকার সাধারণ মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে বজ্রধ্বনি দ্বারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছিলেন। সেই স্লোগানে শের-এ বাঙাল জিন্দাবাদ, শের-এ বাঙাল জিন্দাবাদ। শেরেবাংলার সেই খেতাব দিয়েছিলেন লক্ষেৗবাসীরা, বাঙালিরা নয় অবহেলিত অনগ্রসর। মুসলিম সমাজে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন একজন নেতার আবির্ভাব দরিদ্র, অসহায় মানুষ তথা মুসলিম সমাজের জন্য কত বেশি প্রয়োজন ছিল আজকের বাস্তবতার আলোকে তা ভাষায় ব্যক্ত করা মোটেই সম্ভব নয়। এই ক্ষণজন্মা মুসলিম পুরুষ শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ১৯১৩ সালে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩-১৬ সাল পর্যন্ত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তী সময়ে সভাপতি নির্বাচিত হন। সব ধর্মের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় ও গ্রহণীয় হওয়ার ফলে ১৯১৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯২০ সালে তিনি মোদিনীপুরের প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯২৪ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। বাংলার শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর শেরেবাংলা একে ফজলুল হক বাংলার অসহায় দারিদ্র্য মুসলিম সমাজের লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে অবিরাম নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল।

১৯২১ সালে এক সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতিতে রূপান্তরিত করেন। ওই সম্মেলনে জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রজাদের সংঘবদ্ধ করার দৃঢ় শপথগ্রহণ করা হয়। ১৯২৪ সালে সরকারি চাকরিতে শতকরা ৫০ ভাগ আসন দরিদ্র মুসলমান ও নমঃশূদ্র শিক্ষিত শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, কারমাইকেল হোস্টেল, বেকার হোস্টেল, টেলর হোস্টেল, রাজশাহী আদীনা ফজলুল হক কলেজ, তারও পরে ঢাকার ফজলুল হক মুসলিম হল, চাখার ফজলুল হক কলেজ, ঢাকার ইডেন স্কুল ও ইডেন কলেজ এবং ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা-লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হলে প্রজাতন্ত্রী আইন সংশোধনী বিল, মহাজনী আইন, সূর্যাস্ত আইন রহিত, মুসলিম শিক্ষা বিল বাধ্যতামূলক, বাংলা বিভাগ সৃষ্টি ও বাংলাবিষয়ক বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ (এর পূর্বে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক ইত্যাদি বিষয়ের মতো বাধ্যতামূলক বিষয় ছিল না, ছিল ঐচ্ছিক ভার্নাকুলার হিসেবে) ও পরীক্ষার খাতায় নাম লেখার পরিবর্তে ক্রমিক নম্বর লেখার আইন প্রচলন করেন। প্রতিটি উচ্চ বিদ্যালয়ে একজন মুসলিম শিক্ষক বা মৌলভী রাখা বাধ্যতামূলক ও মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড গঠন, মুসলিম শিক্ষা বিল ইত্যাদি পাস করেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকার মানিকগঞ্জে ও ত্রিপুরা জেলার (তখনো কুমিল্লা জেলা হয়নি), কুমিল্লাতে প্রজা সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির নাম নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা পার্টিতে রূপান্তরিত করা হয়। তারপর পাবনার সিরাজগঞ্জে প্রজা পার্টির নেতা আবদুল হামিদ খান (তখনো তিনি মওলানা ভাসানী নামে পরিচিতি লাভ করেননি)। জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তখন তিনি প্রজা সম্মেলন ডাকেন এবং প্রজা পার্টির সভাপতি ফজলুল হক ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আকরাম খাঁ ওই সম্মেলনে উপস্থিত হন। এতে সভাপতিত্ব করেন সমিতির সভাপতি ফজলুল হক। ওই সম্মেলনে প্রজা পার্টি বিখ্যাত ‘ডাল-ভাত’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ডাল-ভাতের আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে : কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েমের মাধ্যমে বাঙালির শোষণমুক্ত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কৃষক প্রজা পার্টি মূল কর্মসূচি অনুযায়ী পার্টি ১৯৩৭ সালে বাংলা প্রজা কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রজা লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করে মহাজনী আইন পাস করে প্রজাকে মহাজনের ঋণ থেকে মুক্ত করেন এবং সারা বাংলায় ৬০ হাজার ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেন। ফলে সব কৃষক বন্ধকি জমি ফেরত পায় ও খাইখালাসি জমি মহাজনের হাত থেকে ছুটে যায়। এর ফলে কৃষকরা অর্থনৈতিক স্তরে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। পরে অর্থাৎ বর্তমান কৃষকের সন্তানরাই সেদিনের সেই অর্থনৈতিক স্তর সৃষ্টির ফলে আজ দেশ পরিচালনা করেছেন। এসবের মূল উৎস হলো সেদিনের সেই যুগান্তকারী কর্মকাণ্ড।

নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও প্রজা পার্টি যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটায়। এ প্রসঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রাচ্যবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র থেকে এক জরিপে বলা হয় যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য বহু ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল আন্দোলন করেছে কিন্তু সর্বহারা মানুষের জন্য বাংলার প্রজা পার্টি ও তার নেতা ফজলুল হক নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সাধন করেছেন তা এক সার্থক যুগ বিপ্লব।

বাংলা ও ভারত বিভক্ত হলে পার্টি পূর্ব বাংলার জমিদারি স্বত্বের অবসান ঘটায় ও শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ ঘটার ফলে পার্টির নাম কৃষক শ্রমিক পার্টি রাখা হয়। ১৯৫৪ সালের এ পার্টি আওয়ামী লীগ ও নেজামে ইসলাম পার্টিসহ যুক্তফ্রন্ট গঠন করে পার্টিনেতা হন তিনি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা বাস্তবায়নকল্পে বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তরিত করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ও পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা, বাংলার ভাষার সরকারি স্বীকৃতিজ্ঞাপন, রাজবন্দিদের মুক্তি, শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন (কৃষক প্রজা নেতা আবু হোসেন সরকার কর্তৃক ফজলুল হকের নির্দেশে) জমিদারি স্বত্ব উচ্ছেদ করে ফিউডাল জমিদারদের শোষণের চির অবসান ঘটান। পরে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেলে ফজলুল হক পাকিস্তান কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রী এবং পরে পূর্ববাংলার গভর্নর হন। এরপর দেশে প্রথম সামরিক আইন চালু হয়। সামরিক আইন জারির ফলে সব রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বেআইনি ঘোষিত হয়।

ভারত বিভাগ সম্পর্কে পার্টি খণ্ডিত বাংলার বিরুদ্ধে মত পোষণ করেছিল। পার্টি মনে করে বঙ্গ দেশকে খণ্ডিত করার সময় ইস্যুর ওপর জনগণের কোনো ম্যান্ডেট না নিয়েই সাম্রাজ্যবাদীরা দাবার ঘুঁটি হিসেবে বঙ্গ দেশকে খণ্ডিত করায় অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক দিক দিয়ে দেশ দুর্বল হয়েছে বেশি। তখন পার্টির দাবি ছিল ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ দেশেরও স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দিতে হবে।

লেখক : এমএ রহমান

 চেয়ারম্যান পিডিএসসি লি.

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads