• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবেলায় জনসচেতনতা

  • প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০১৮

বাংলা নতুন বছর ১৪২৫ আজ ১৪ দিনে পা দিয়েছে। এর ১৩ দিন আগে বাঙালি বাংলা বর্ষবরণে প্রাণের উৎসবে মেতেছিল। কিন্তু একটি বছরের শেষ অর্থাৎ চৈত্র থেকেই নদীমাতৃক এই ভাটির দেশে দেখা দেয় অকস্মাৎ ঝড়, সাইক্লোন, বন্যা ইত্যাদি। পদ্মা-মেঘনার বুকে ডুবতে দেখা যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ, বেড়ে যায় বাস দুর্ঘটনা, বজ্রপাত কিংবা ভূপাতিত গাছের তলে পড়েও প্রাণ হারায় অভাগা কেউ কেউ। এ থেকে উত্তরণে তিনটি বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, তা হচ্ছে— ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত এবং ভূপাতিত গাছ।

১.

বাংলা বছরের প্রথম মাস যে বৈশাখ, তার সূচনা ঘটে ইংরেজি মার্চ মাসের মধ্যভাগ হতে। সে হিশেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবছরের ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। বাংলাদেশে এ-সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত ঘূর্ণিঝড় রূপে আমজনতার কাছে পরিচিত। কিন্তু এই ঘূর্ণিঝড়ে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক জনপদের মানুষজনের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানা থাকলেও তাদের ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্কেত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। আর তাই এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ অঞ্চলের মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে।

মাইকিং করে চরের জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বললেও বাড়ি ছেড়ে পরিবারের সব সদস্য যে আশ্রয়কেন্দ্রে যায় না, তা বোঝা গেল গত বছরের ঘূর্ণিঝড় মোরার সময়। তা ছাড়া কোন সঙ্কেতে কোন ধরনের ক্ষতিসাধন হওয়ার ঝুঁকি তাও তারা জানে না। এমনকি এসব নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত মানুষজন ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে সঙ্কেত দেওয়া হচ্ছে তাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেও না। কেননা এ-সময় তাদের কাছে নিজের জীবনের চেয়েও গৃহপালিত পশুর জীবন অনেক মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়। এসব মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রাণী বা বস্তু এই দুর্যোগে তারা পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাবে, তা হতে পারে না। তাই ঘূর্ণিঝড়ের মতো যেকোনো সাইক্লোন বা টর্নেডোতে এ অবস্থা বিরাজ করে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি জনপদে।

সুতরাং সরকারিভাবে উপকূলের সাধারণ মানুষের জন্য দুর্যোগ-পূর্ববর্তী ও দুর্যোগ-পরবর্তী নানা সতর্কতা থাকলেও তা কাজে আসছে না। ফলে প্রতিবছর একের পর এক দুর্যোগে হারাতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জানমাল ও সম্পদ। এমতাবস্থায় এতদাঞ্চলের মানুষের জন্য বিপদসঙ্কেত বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষায়ও স্থানীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা তারাও কখনো নিজ গৃহ ও সম্পদ অরক্ষিত রেখে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে চাইবে না। তবে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশিক্ষণে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। কেননা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এরাই প্রথমে ক্ষতির শিকার হয়ে থাকে।

২.

পশ্চিমাকাশ কালো করে আসা অকস্মাৎ ঝড়-ঝঞ্ঝায় বজ্রপাতের আধিক্য ইদানীং পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই অধিক বজ্রপাত নিয়েও বিশেষজ্ঞদের নানা অভিমত রয়েছে। বিশেষ করে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বজ্রবৃষ্টির মেঘগুলো এমন এলাকায় তৈরি হয়, যেখানে সূর্যের তাপ বেশি পড়ে, পরিবেশ উত্তপ্ত থাকে, গরম হয় এবং বাতাসে প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্লোবালই যে তাপমাত্রা বাড়ছে বাংলাদেশ তার শিকার। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান। আর তাই ষড়ঋতুর এই দেশে চৈত্র থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দক্ষিণা বাতাসের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ জলীয়বাষ্প চলে আসে। যে কারণে গ্রীষ্মকালে বিশেষ করে মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে বাংলাদেশের উপরে প্রচুর বজ্রবৃষ্টির মেঘ তৈরি হয়। আর তা থেকে বজ্রঝড় হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে দিনে প্রায় ৮০ লাখ বার বজ্রপাত হয়। এতে মৃত্যুর হার অনেক। আর প্রতিবছর বজ্রপাতে বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ২০০ মানুষ মারা যাচ্ছে।

কিন্তু শুধু বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ুর পরিবর্তনই বাংলাদেশে অধিক বজ্রপাতের একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মানুষসৃষ্ট কিছু পরিবেশগত বিষয়। যেমন— একদিকে নগরায়ণের নামে বড় বড় গাছগাছালি কেটে ফেলা হচ্ছে, খাল-বিল-জলাশয় ভরাট করে অট্টালিকা তৈরি করা হচ্ছে; অন্যদিকে মোবাইল ফোনসহ যান্ত্রিক ব্যবহার বৃদ্ধি মানুষকে বজ্রপাতের নিশানা করে তুলছে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, বায়ুমণ্ডলে ধাতব উপাদান বেড়ে গেলে তা বজ্রপাতের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আগে কৃষকের কাছে বড়জোর কাস্তে থাকত। কিন্তু এখন ট্রাক্টরসহ নানা কৃষি যন্ত্রাংশ বা মুঠোফোনের মতো ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসব ধাতব বস্তুর ব্যবহার বজ্রপাতে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করছে। উপরন্তু এ ধরনের বজ্রপাত থেকে রক্ষায় মাটির নিচে যে ধাতব পিলারগুলো ছিল, সেগুলোও ক্রমান্বয়ে চুরি হয়ে গেছে আমাদের কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে। ফলে ইদানীং এই বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রাণহানিও বাড়ছে। 

প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে প্রথমত জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ সময়ে খোলা জায়গা, টিনের চালা অথবা ছাউনির নিচে না থেকে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে হবে। ঘরের বাইরে থাকলে সম্ভব হলে বড়গাছ পরিহার করে ছোট গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বজ্রপাত ৮ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে গিয়েও আঘাত হানতে পারে এবং মাটিতে আঘাত হানার পরও মাটি থেকে ১০০ ফুট দূরত্বে গিয়ে পুনরায় আরেকজনকে আঘাত করতে পারে। সুতরাং বজ্রপাত শেষ হওয়ার কমপক্ষে আধা ঘণ্টা পরে বাইরে বের হওয়া উচিত। এ ধরনের জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টি দিতে হবে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক কারণে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিতে।

৩.

এই ঝড়-ঝঞ্ঝার মৌসুমে আরো একটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূপাতিত গাছ। বিগত দুই বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে গাছচাপায় নিহত হন এক চিত্রশিল্পী-চলচ্চিত্রকার এবং ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাছ পড়ে দুজন পিকআপ আরোহী আহত হয়েছেন। উপরন্তু এ-সময় বিভিন্ন সড়কে গাছ ভূপাতিত হয়ে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। মূলত প্রচুর বজ্রপাতের সঙ্গে শিকড় দুর্বল হওয়া ফাঁপা গাছগুলো যত্রতত্র ভূপাতিত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রতিবছর এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য দুর্ঘটনার কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি ভেবে দেখেছে? ঢাকার রাস্তা ও ফুটপাথের ধারে ইট ও কংক্রিট দিয়ে ঘেরা এই গাছগুলোর শেকড়ের সঙ্গে মাটির সংযোগ নেই বললেই চলে। উপরন্তু উন্নয়নমূলক কাজে প্রায়ই কাটা পড়ে থাকে গাছের শেকড়, সরে যায় গোড়ার মাটি, দুর্বল হয়ে পড়ে গাছের ভিত্তি। আর এ কারণেই গত বছর চন্দ্রিমা উদ্যানসংলগ্ন সড়কে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ভূপাতিত হলে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন।

সুতরাং এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য দুর্ঘটনা এড়াতে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ঝুঁকিপূর্ণ গাছ কেটে ফেলার পাশাপাশি জনবহুল স্থানে বট-অশ্বত্থ, কৃষ্ণচূড়া বা রাধাচূড়া জাতীয় গাছ না লাগানোই ভালো। এর বিপরীতে ছাতিম, জারুল, নিম ও বকুলের মতো মাটির গভীরে শেকড় প্রবেশকারী গাছ লাগানোই সঙ্গত হবে। আবার রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর নিয়ম মেনে এসব গাছের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ ফুট দূরত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া গাছ পোঁতার গর্তটির ব্যাস এবং গভীরতা দুটোই হতে হবে দুই ফুট। তা না হলে গাছের শেকড় গভীরে প্রবেশ করতে পারবে না। এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, শুধু সৌন্দর্য বর্ধনে সড়কের পাশে গাছ লাগাতে ইট ও কংক্রিটের ঢালাই দিলেই চলবে না, তার জন্য প্রয়োজন উপযোগী মাটি। যা গাছের বর্ধনে, সজীবতা রক্ষায় ও শক্তি বৃদ্ধিতে খুবই প্রয়োজন। আর এভাবেই অহেতুক প্রাণহানি থেকেও নগরবাসীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

 

৪.

পরিশেষে বলব, সরকার দুর্যোগের সম্ভাব্য সময় চিহ্নিত করে দিলেই হবে না, দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলীয় চরাঞ্চলের মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোয় ওয়ার্ডভিত্তিক জনসচেতনতামূলক সভা করে সঙ্কেত বিষয়ে সম্যক ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। তা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলায় অধিক হারে গাছ লাগানো জরুরি। নগরায়ণের নামে জলাশয় ভরাট বন্ধ করা এবং মাটির নিচের ধাতব পিলার সংরক্ষণে কাজ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলা ও জানমালের ক্ষতি হ্রাসে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের এখনই কাজ শুরু করা উচিত।

লেখক: মামুন মুস্তাফা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads