• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি: কাল্পনিক

মতামত

পারমাণবিক ইস্যু প্রসঙ্গ

  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০১৮

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা শেষে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলো গভীরভাবে উপলব্ধিতে আনতে পেরেছিল যে, যুদ্ধ কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। একটি শান্তিময় বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে গেল। বিশ্বশান্তি স্থাপনে জাতিসংঘের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। যদিও বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাপে পড়ে জাতিসংঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠানও মাঝেমধ্যে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়।

তবে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল তার রেশ বোধহয় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই তো অনেক রাষ্ট্রের অস্ত্রের যে ঝনঝনানি এবং পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় যে তর্জন-গর্জন এবং আধিপত্য বিস্তারের যে আকাঙ্ক্ষা তাতে করে ন্যায়-অন্যায় বোধ আর মানবাধিকারের প্রসঙ্গগুলো যেন ম্লান হয়ে যায়। বিশ্বশান্তি যেন আজ সুদূরপরাহত। এমতাবস্থায় বিশ্বপরিস্থিতি মাঝেমধ্যে একটি টালমাটাল অবস্থায় রূপ নেয়। এই তো সাম্প্রতিক সময়গুলোতে উত্তর কোরিয়ার একের পর এক পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কিম জং উন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে যে শিশুসুলভ বাক্যালাপের উন্মত্ততা প্রকাশ পেয়েছিল তাতে করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন দ্বীপ গুয়ামের শত-সহস্র মানুষ একপ্রকার আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে দিনতিপাত করছিল। কখন যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, এমন একটি উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। উত্তর কোরিয়ার ঘোষণায় ছিল তাদের দূরপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডেও আঘাত হানতে সক্ষম।

বিষয়টি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ব্রিটেনকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৩ সালের মার্চে মারাত্মক মারণাস্ত্রের দোহাই দিয়ে যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাক আক্রমণ করেছিল (যদিও কোনো মারণাস্ত্রের মজুত পাওয়া যায়নি), ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্তত এখন অবধি তা করেননি। তিনি জাতিসংঘের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার ওপর বরাবরের মতো বিভিন্ন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থা করেন। এখানে ট্রাম্পের কৌশলগত দিকের প্রশংসা না করলেই নয়, কেননা তিনি উত্তর কোরীয় নেতার সঙ্গে আলোচনার টেবিল উন্মুক্ত রাখলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সিআইএ ডাইরেক্টর এবং সেক্রেটারি অফ স্টেট নমিনি মাইক পম্পেও কিং জং উনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অচিরেই উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন ও তার পর পরই ট্রাম্পের সঙ্গে পৃথক শীর্ষ বৈঠকের কথা রয়েছে। আর এমন একটি সময় কিমের পরমাণু কর্মসূচির বন্ধের ঘোষণা এলো। এটি যেন গ্রীষ্মের গরমের মাঝে হঠাৎ একপশলা বৃষ্টি। ধরে নেওয়া যেতে পারে এটি ট্রাম্পের কূটনৈতিক সাফল্যের একটি ধাপ। এরকম একটি খবরে ট্রাম্প নিজেও টুইট বার্তায় জানান, ‘North Korea has agreed to suspend all Nuclear Tests and close up a major test site. This is very good news for North Korea and the world. It's a  big progress! Look forward to our Summit.’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, কিমের এই রকম ঘোষণার উদ্দেশ্য কী? তবে কি তিনি সকল বৈরিতা ভুলে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেতে আগ্রহী? বিশ্ববাসী কি সকল ভেদাভেদ ভুলে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ প্রত্যক্ষ করবে? এই আকাঙ্ক্ষাটি কতটুকুই বা সফলতা অর্জন করবে এটি এখন দেখার বিষয়।

লক্ষণীয় যে, ইয়েমেন, ভিয়েতনাম এবং ১৯৯০ সালের অক্টোবরে বার্লিন দেয়াল ভেঙে ইউরোপের পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে যেতে পারলেও দুই কোরিয়া আজ অবধি এক হতে পারেনি। মূলত ১৯৫০ সালের পর থেকে দুই কোরিয়া নিয়ে পানি কম ঘোলা হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন মিত্র হওয়ায় এখানে প্রায় সাঁইত্রিশ হাজার মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি উত্তর কোরিয়ার গাত্রদাহের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রয়েছে চীনের ঐতিহাসিক সুসম্পর্ক এবং সীমান্ত। স্বাভাবিকভাবে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি চীনকেও গভীরভাবে ভাবায়। এরকম একটি পরিস্থিতিতেই সম্প্রতি কিং জং উন তার প্রথম বিদেশ সফরে চীনকেই বেছে নেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বোঝা যাচ্ছে, তিনি চীনের প্রেসিডেন্টের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। বলা যায়, বয়সে তরুণ এই নেতা পারমাণবিক ইস্যুতে সারা বিশ্বের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তিনি হয়তো এটা ভেবেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে আমরা কেন পারব না? কিম স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘পরমাণু শক্তি অর্জন উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তা ও মর্যাদা দিয়েছে এবং এ পরমাণু অস্ত্রের দ্বারাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্বে সুখী ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন কাটাতে পারবে।’

প্রশ্ন হলো, পারমাণবিক ইস্যু প্রসঙ্গে একজন রাষ্ট্রনায়কের এ ধরনের মনোভাব কেমন করে হলো? যেখানে আমরা সবাই জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাতে মুহূর্তেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল এবং পরবর্তীতে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত একটি শান্তিময় বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় বিশ্বনেতাদের মাঝে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। একই সময়ে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের মাঝে আবার নতুন করে বািবতণ্ডা শুরু হয়েছে। ২০১৫ সালে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির মধ্যে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তির বিষয়ে ট্রাম্প নতুন করে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। আগামী ১২ মে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি পুনরায় অনুমোদন না করলে চুক্তিটি কার্যকারিতা হারাবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি নিয়ে ট্রাম্প আবার প্রশ্ন তুলছেন। এটিই বোধহয় ট্রাম্পীয় দর্শন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাবেদ জারিফ এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘চুক্তিসংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলো যতক্ষণ এই চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাবে ততক্ষণ তারা তা মেনে চলবে। তবে ওয়াশিংটন চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলে চুক্তিটি টুকরো টুকরো করে ফেলবে তারা। একই সঙ্গে তেহরানের স্থগিত পরমাণু কর্মসূচি নতুন করে এবং আরো দ্রুত গতিতে চালানো হবে।’ এখানে উল্লেখ্য যে, পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি-এনপিটির মূল ভিত্তিগুলোর একটি হলো, পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকার। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১৭৮টি রাষ্ট্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশও চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি রাষ্ট্র। কিন্তু যে ৯টি রাষ্ট্র এখনো CTBT (Comprehensive Nuclear Test Ban Treaty) অনুসমর্থন করেনি সেগুলোর মধ্যে উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং ইসরাইল রয়েছে। অবাক ব্যাপার হলো, মধ্যপ্রাচ্যের এই অবৈধ দখলদারিত্বের দেশ ইসরাইলের পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় নীরব থেকেছে।

লেখক : ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads