প্রায় এক হাজার বছর আগে জুমিয়া ও কৃষকরাই ভিন্ন জলবায়ু ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বৈচিত্র্যময় অগণিত শস্য ফসলের বুনো জাতকে আবাদি জাতে পরিণত করেছিলেন। আন্দিজ অঞ্চলের কৃষকরা প্রায় ৩ হাজার আলুর জাত, পাপুয়া নিউগিনির কৃষকরা প্রায় ৫ হাজার মিষ্টি আলুর জাত এবং ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষকরা হাজার হাজার ধানজাত উদ্ভাবন করেছিলেন। গোলার্ধব্যাপী নারী-কৃষকরাই আবাদি জাতের বীজ মজুত ও বিস্তারের কৌশল ও ধারা বংশ থেকে বংশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বীজের বংশরক্ষায় নারীর এ অবিস্মরণীয় ভূমিকাকে আমল না দিলেও দুনিয়ার জুম-কৃষি ও খাদ্য-ভূগোল ডানা মেলেছে নারীর বীজরক্ষার কোলজুড়েই। কিন্তু কে ধারণা করেছিল বীজসম্পদকেও পুঁজিবাজারের পণ্য করা হবে। নারীর বীজভান্ডারের মজুত নিঃস্ব করে বীজের নিয়ন্ত্রক ও মালিক হয়ে উঠবে দশাসই সব বহুজাতিক কোম্পানি। জুম ও কৃষি হলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শ্রম ও অভিজ্ঞতার এক জটিল মিথষ্ক্রিয়া। কৃষি ও জুমের ঠিকুজি হলো বীজপ্রাণসম্পদ। যুগ যুগ ধরে নারী-কৃষকরাই কৃষি ও জুমের এ ঠিকুজি গণনা বিচার করলেও পণ্য বিশ্বায়নের এ যুগে বীজ-ঠিকুজি নিয়ন্ত্রণ করছে করপোরেট কৃষি-বিষ ও বীজ কোম্পানিগুলো। ষাটের দশকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষকের এ বীজ-ঠিকুজি দখলের বৈশ্বিক বাণিজ্য-রাজনীতি শুরু হয়েছিল। মাত্র পঞ্চাশ বছরে আজ আর গ্রামের কোনো কিষানি বা জুমপাহাড়ের আদিবাসী জুমিয়া নারী দেশের বীজসম্পদের মালিক নয়। বীজসম্পদ এখন কোক-পেপসি কি মশার কয়েলের মতো বাজারে কেনাবেচার পণ্য? কোম্পানির মর্জিমাফিক এখন একেক বীজের একেক দাম। বীজকে পণ্যে পরিণত করার ভেতর দিয়ে নারী-কৃষকের সামাজিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বীজের মতো সামাজিক সম্পদের রক্ষক থেকে নারী ও পুরুষ সব লিঙ্গের কৃষককেই বীজের প্রশ্নহীন ক্রেতা ও বীজ-দাসে পরিণত করা হয়েছে। বীজসহ জনসম্পদ দখলের এই নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতাগুলোকে বৈধতা দেওয়ার ভেতর দিয়েই টিকে থাকছে বাংলাদেশের মতো কৃষিভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র ও তার কৃষিবিচ্ছিন্ন জাতীয় সরকারগুলো। তাই দেখা যাচ্ছে, করপোরেট কোম্পানিগুলো একটির পর একটি বীজ-প্রতারণা ও লাগাতার মিথ্যাচার চালু রেখেও সব সরকারের আমলেই পার পেয়ে যাচ্ছে। দেশের কিছুসংখ্যক বিদেশি কোম্পানি আজ বাংলাদেশের বীজসম্পদের একতরফা দখল নিয়ে বাণিজ্য চাঙ্গা রেখেছে।
২.
নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রশ্নে বরাবর নারীর জুম-কৃষি অধিকারের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এই বহুজাতিক পণ্য ব্যবস্থায় নারীর ওপর সবচেয়ে মারদাঙ্গা নির্যাতনই করপোরেট নির্যাতন। জুম-কৃষির মতো নারীর নিজস্ব স্বনির্ভর জীবিকা ও প্রতিবেশ থেকে নারীকে উচ্ছেদ করে নারীর বীজ সংরক্ষণের ধারাবাহিক চর্চাকে বিপন্ন করেছে কিছু করপোরেট কোম্পানি। তাদের প্যাকেটে প্যাকেটে বন্দি হয়ে যায় নারীর শস্য ফসলের বীজভান্ডার। নারীর ঔষধি জ্ঞান ও উদ্ভিদ প্যাটেন্ট করে যখন বিদেশি ওষুধ কোম্পানির ব্যবসা চাঙ্গা হয়, আদিবাসী নারীদের কাপড়ের ডিজাইন যখন হয়ে ওঠে করপোরেট ফ্যাশন ব্যবসা, নারীর ওপর যখন চেপে বসে বিদেশি কোম্পানির মনোপলি বাজার, তখন ‘নির্যাতন’ বিষয়টিকে আর একধরনের ব্যাখ্যা হিসেবে ভাবা যায় না।
নারীর ওপর নির্যাতন এবং সহিংসতাকে অধিকাংশ সময়ই শারীরিক নিপীড়ন-ধর্ষণ-আঘাত এবং বাল্যবিবাহ বা যৌতুক দিয়েই পাঠ করানোর ব্যবস্থা থাকে। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদের (১৯৯২) ৭৯৮ পৃষ্ঠার দলিলের প্রস্তাবনা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ...জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বসনিয়া এবং হারজেগোভিনায় বিশেষ করে মুসলিম নারীর ওপর ব্যাপক সংঘটিত এবং পদ্ধতিগত ধর্ষণের খবরে মর্মাহত। কিন্তু নারীর আপন বিরাজমানতার সংসার এবং স্থানীয় পরিসরনির্ভর কাঠামো যখন করপোরেট কোম্পানির বাণিজ্য-আঘাতে চুরমার হয়ে যায়, তখন সেসব আঘাতকে নারীর প্রতি সহিংসতা হিসেবে দেখানো হয় না বা দেখানোর কোনো প্রচলন তৈরি হয় না। এর মানে এই নয় যে, নারীর ওপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক আঘাত এবং সহিংসতাকে আমরা কোনোভাবে ‘পাশ’ কাটিয়ে যাচ্ছি। একেবারে খোলামেলাভাবে বললে বলা যায়, যখন পাহাড়-টিলা-সমতলের নারীর কৃষি বা জুমের ভেতর ঢুকে পড়ে বিভিন্ন কোম্পানির কৃষিবাণিজ্য এবং তা বিপন্ন করে তুলে নারীর আপন অস্তিত্ব বা নারীর যুগান্তরের প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জ্ঞানপরিসরকে ধাক্কা মেরে যখন চালু হয় করপোরেট পণ্যবাজার, তখন সেই বলপ্রয়োগকে আমরা সহিংসতা হিসেবেই পাঠ করতে আগ্রহী, কারণ এটি ঘটছে, প্রশ্নহীনভাবে ঘটছে। নারীর সমঅধিকার বা নারী উন্নয়নের সব পরিপ্রেক্ষিতেই এই সহিংসতা আড়ালের চেয়েও আড়ালে, প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর বাহাসের ময়দানে থেকে যাচ্ছে। তথাকথিত নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার এ সহিংস ধারাকে ‘নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা’ হিসেবে আলোচনা করতে গিয়ে চলতি আলাপে সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এক বিদেশি কোম্পানির একটি বীজ-সহিংসতাকে ঘটনা হিসেবে হাজির করছি।
৩.
২০১০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার হাজারো কৃষক একটি কোম্পানির হাইব্রিড টমেটো বীজ কিনে নিঃস্ব ও প্রতারিত হন। শীত মৌসুমে টমেটো চাষের জন্য কৃষকরা স্থানীয় ডিলার থেকে সবল এফ-১ হাইব্রিড টমেটো বীজ কিনে জমিনে লাগানোর পর কোনো ফল না আসায় প্রতারিত হন। প্রতারিত কৃষকরা গোদাগাড়ী কৃষি উন্নয়ন ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ২৩ নভেম্বর গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ী পশুরহাটে বিক্ষোভ সমাবেশে বীজ-প্রতারণার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি তোলেন প্রথম। কৃষকদের এই ন্যায্য দাবির সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিক সমাজও একাত্ম হন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেন, যার অনুলিপি কৃষিমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিসচিব ও কৃষি অধিদফতরের মহাপরিচালকদেরও দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত চার কৃষক ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর রাজশাহীর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেন। এ নিয়ে বেশ ক’টি সরকারি তদন্ত হয়। রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী বেশ জোরেশোরে বীজ-প্রতারণার বিষয়টি জাতীয় সংসদে কয়েকবার উত্থাপন করেন। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে সুরাহা করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বীজ-প্রতারণার সাক্ষী পাঁচ হাজার কৃষক তাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য ও স্বাক্ষরসহ সরকারের কাছে এক করুণ স্মারকলিপি পেশ করেন।
বীজ-প্রতারণার বিষয়টি নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিক কায়দায় ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল নানাভাবে। বীজ-প্রতারণার দীর্ঘদিন পর যখন কৃষকদের আন্দোলন তুঙ্গে, তখন উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, ভেজাল ও নকল বীজ বিক্রি এবং ব্যবহারেই কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আন্দোলনরত কৃষকরা রাজশাহীতে ওই প্রতিষ্ঠানের অফিস ঘেরাওয়ের পর প্রতিষ্ঠানটি তার বিশাল সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলে। ওই প্রতিষ্ঠানটির মতো করপোরেট কোম্পানি এই প্রথম নাকানিচুবানি খেয়েছে বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশে সব জায়গা থেকেই। ধরা খেয়েছে কৃষক, গণমাধ্যম, জনপ্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক সংগঠন, গবেষক, লেখক, কৃষি অফিস, আদালত থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। ২০১১ সালের ১ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটিকে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত দেড় হাজার কৃষকের মাঝে ২০ গ্রাম করে টমেটো বীজ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার চিঠি দেয়। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রতিষ্ঠানটি তার মিথ্যাচার ও বীজ-প্রতারণা বন্ধ করেনি। হাইব্রিড টমেটো বীজ বিক্রি করে রাজশাহী অঞ্চলে ধরা খাওয়ার পর ২০১১ সালের নভেম্বরে এই প্রতিষ্ঠান হাইব্রিড ভুট্টা বীজ বিক্রি করে আবারো ধরা খায় চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে।
৪.
২০১১ সালের জুলাই মাসে বরেন্দ্রর ক্ষুব্ধ কৃষকরা বিচার না হওয়া পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের সব পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে আরো জোরালোভাবে আন্দোলন শুরু করেন। টমেটোর পর ভুট্টা, রাজশাহীর পর চুয়াডাঙ্গায় বীজ-প্রতারণার খবর ছড়িয়ে পড়ায় কোম্পানিটি তার ভোল পাল্টাতে বাধ্য হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বীজসম্পদের ‘ব্যবসা’ করে, কিন্তু কৃষকরা বীজকে বারবার কৃষির বংশরক্ষার এক ‘সামাজিক মালিকানার সম্পদ’ হিসেবে দেখতে চায়। বীজ সংরক্ষণের যাবতীয় দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র যখন কৃষক-নারীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে করপোরেট কোম্পানির কাছে দাসখত দেয়, তখন বীজবাণিজ্যের এই নয়া কৌশলকে নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার হিসেবেই আজ পাঠ করতে হয়। লিঙ্গীয় ন্যায়বিচারের সুরক্ষায় নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা ও নারীর ওপর সব ধরনের পুরুষতান্ত্রিক করপোরেট সহিংসতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নারী-পুরুষের সমঅধিকার ‘নারী-অধিকার’ কি ‘নারী-পুরুষের সমঅধিকার’ নিয়ে গলাফাটানো নাগরিক আওয়াজেও কখনোই বীজ-প্রতারণার মতো করপোরেট সহিংসতাকে পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন হিসেবে দেখা হয় না। এটি চলতি নাগরিক আন্দোলনের এক ‘হেজিমোনাইড দশা’ হলেও আজ বাংলার নারীর বীজ সুরক্ষার প্রশ্নে সবাইকে বীজ-প্রতারণার মতো সব করপোরেট প্রতারণার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি। মিথ্যাচার ও বীজ-প্রতারণার বিচারও বিলম্বিত হয়। তাই সব মিথ্যাচার, প্রতারণা, পুরুষতান্ত্রিকতা ও দাসখতের বিরুদ্ধে জনগণকেই রচনা করতে হয় বাংলার নারী-কৃষকের বীজ-ন্যায়পরায়ণতার দুর্বিনীত ইশতেহার।
পাভেল পার্থ
গবেষক
animistbangla@gmail.com