• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী খনন ও সংরক্ষণ

  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০১৮

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার জলাবদ্ধতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ এলাকার বিল, জনপদ, ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান। ফসল হারাচ্ছে কৃষক। আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভেঙে পড়ছে, অনেক অবকাঠামোও নষ্ট হচ্ছে শুধু জলাবদ্ধতার কারণে। কয়েক লাখ একর ফসলি জমিতে ঠিকমতো ফসল ফলানো যাচ্ছে না। উল্লেখিত তিনটি জেলা ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের কিছু অংশেও এর প্রভাব পড়েছে। সবমিলিয়ে পাঁচটি জেলার ১৭টি উপজেলায় জলাবদ্ধতার কারণে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে প্রায় এক  কোটি মানুষ। এ অঞ্চলটি উপকূলে বা তার খুব কাছাকাছি অবস্থিত। অতিবৃষ্টির পানি নদীতে এবং নদীর পানি সাগরে পড়লেই তো জলাবদ্ধতা নিরসন হওয়ার কথা। কিন্তু যতই নদী নাব্য হারাচ্ছে, ততই উপকূলীয় জলাবদ্ধতা সঙ্কট বাড়ছে। তাই নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

পরিকল্পিতভাবে নাব্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যদিও তা ব্যয়বহুল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা নিরসন বড় কঠিন। কারণ নদীর তীর পলি পড়ে ভরাট হওয়ার আগেই তা দখল ও অবকাঠামো তৈরি করায় এখন অনেক নদী প্রশস্তকরণ বা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে পুনর্খনন সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে আমরা যদি ভবিষ্যতের ভয়াবহতার দিকে তাকিয়ে সেটা উপলব্ধি করি, তবে খুলনা-সাতক্ষীরা-যশোর তথা দক্ষিণ-পশিচমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি নদী বাঁচাতে, পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করতে একটি সবিশেষ উদ্যোগ বা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। সে বিবেচনায় খুলনার পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিশেষত মহাসড়কের উত্তর-পশ্চিমাংশের জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানি নিষ্কাশনে কৈয়া, ভদ্রা-বুড়িভদ্রা, কপোতাক্ষ, মরিচচাপ, ভৈরব ও প্রাণসায়েরের খাল- এসব নদ-নদীর নাব্য পুনরুদ্ধার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু চোখের সামনেই দিনে দিনে এসব নদী নানাভাবে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণকায় হচ্ছে। এর মধ্যে হাকুড়া নদীর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। মাত্র ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই স্রোতস্বিনী এ  নদী লুপ্ত হলো কেবল ভরাট নদীর শত শত একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার কারণে। যদি উপকূলীয় বা অভ্যন্তরীণ নদ-নদী বা খালের ক্ষেত্রে এমন একটি ক্লজ (ধারা) সে ক্ষেত্রে থাকত যে, ভরাট হলেই তা স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না, এর ওপর  স্থায়ী কোনো অবকাঠামো তৈরি করা যাবে না, কেবল ফসল উৎপাদন ও মৎস্য চাষ করা যাবে এবং সরকারের প্রয়োজনে পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় অংশ ছেড়ে দিতে হবে, তা হলে এক্ষেত্রে পুনরায় অধিগ্রহণের প্রশ্ন ও অর্থের বিষয়টি এতটা কঠিন হয়ে দেখা দিত না।

সে যা-ই হোক, আমরা যদি বর্তমান অবস্থা কাছে থেকে দেখি তাহলে দেখা যাবে খুলনা শহরে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। বর্তমান শহর আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে পশ্চিমে কৈয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। ফলে বর্তমান ময়ূর নদীই কেবল পানি নিষ্কাশনে সক্ষম বলে বিবেচিত হবে না। সে বিবেচনায় নতুন করে নগরায়িত গল্লামারী থেকে কৈয়া, উত্তরে কুয়েট থেকে শলুয়া (বিল ডাকাতিয়ার একাংশ) পর্যন্ত নববিস্তৃত শহরের পানি নিষ্কাশন হবে কোন পথে? এখানে একমাত্র পথ কৈয়া নদী। এ নদীর শেষ প্রান্ত বটিয়াঘাটা-ডুমুরিয়ার শোলমারী নদীতে সংযোগস্থলে ৩০ বছর আগে একটি ক্লোজার নির্মিত হয়েছিল বলে রক্ষা। ফলে নদীটির এক-তৃতীয়াংশের অস্তিত্ব এখনো আছে এবং পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তার পরও এ নদীর দুই তীর ধীরে ধীরে দখল হচ্ছে এবং স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে উঠছে যা কৈয়া বাজারের ব্রিজের ওপর দাঁড়ালেই দৃশ্যমান হয়। বলতে গেলে, এ নদীটি রক্ষা করা না গেলে খুলনা ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভবিষ্যৎ পানি নিষ্কাশনের পথ থাকবে না। ফলে অবধারিত জলাবদ্ধতায় ডুববে নতুন এ বিস্তীর্ণ এলাকা। তাই এখনই কৈয়া নদী শলুয়া পর্যন্ত খনন ও পুনরুদ্ধার এবং এর শাখা সরকারি খালগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন।

এ অঞ্চলের আরেকটি নদী ভদ্রা। তবে এটা সত্য যে, কেশবপুর পর্যন্ত একসময় যে ভদ্রার শাখা নদী ছিল, তা ভরাট হলে পুনরায় খনন হয়েছে। কিন্তু ততদিনে নদীর দু্ই-তৃতীয়াংশ  দখল হয়ে গেছে। এখন ইচ্ছা থাকলেও নদী বড় করার উপায় নেই। ঠিক ভবদহের সঙ্গে সংযুক্ত অসংখ্য শাখা নদী-খাল এভাবে দখল হয়েছে নতুবা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এককালের নামকরা ভবদহ বা কপালিয়ার স্লুইচ গেট অকার্যকর হয়ে গেছে। অপরদিকে বিলের মধ্যবর্তী অংশ নিচু আর বাইরে নদীতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে উঁচু হচ্ছে। এটিই মূলত উপকূলীয় নদী ভরাট হওয়ার প্রবণতা এবং জলাবদ্ধতার প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে আশপাশের বিল উন্মুক্ত করে জোয়ারধারা সৃষ্টির মাধ্যমে নদীর নাব্য অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আবার যেই জোয়ারধারা বন্দ করা হবে অমনি কয়েক বছরের মধ্যে একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি দেখা দেবে। তাই বিষয়টি পানি বিশেষজ্ঞ বা সংশ্লিষ্ট গবেষকদের ভাবতে হবে।

ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় কপোতাক্ষ নদ পশ্চাৎপদ বিশাল এক অববাহিকার নিয়ামক, প্রভাবকস্বরূপ। এর সঙ্গে জড়িত খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গাসহ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জনপদের অন্তত অর্ধকোটি মানুষের ভাগ্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অববাহিকার কয়েক লাখ একর জমির ফসল, আবহাওয়া ও জলবায়ু তথা প্রতিবেশ ও পরিবেশগত প্রভাব এর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কপোতাক্ষ নদকে ঘিরেই রয়েছে অববাহিকার কোটি মানুষের স্বপ্ন। জীবন-জীবিকার বহুমুখী সমস্যা ও সম্ভাবনা। তাই কপোতাক্ষ নদ ও এর অববাহিকার সমস্যা নিরসন করে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এ নদকে ঘিরেই একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। অন্যদিকে কপোতাক্ষ এলাকার সেচ ও পানি নিষ্কাশনের পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কপোতাক্ষ নদের অংশে ও অন্য উল্লেখিত নদীর খনন করা অংশে মাছের অভয়ারণ্য করে দেশীয় প্রজাতিসহ নানা প্রজাতির মাছের পরিকল্পিত চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। নওয়াপাড়ার পর থেকে যশোরের রাজার হাট এবং তা ছাড়িয়ে ঝিনাইদহ পর্যন্ত প্রবহমান ভৈরব নদ খননের মাধ্যমে যশোর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পানি নিষ্কাশনে বড় সুবিধা সৃষ্টি সম্ভব। যশোরবাসী দীর্ঘদিন ধরে এ নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও পুনর্খননের দাবি জানিয়ে আসছেন।

মরিচচাপ নদীটি একসময় প্রশস্ত ও প্রমত্তা ছিল। বর্তমান খননের পর সাতক্ষীরার ৬-৭ কিলোমিটার আগে এ নদীটিও শাসিত খালে পরিণত হয়েছে। যেটুকু খনন করা হয়েছে, তাতে আর নদীর রূপ নেই। পাশের জমি দখল বা বরাদ্দ নিয়ে অবকাঠামো করা হচ্ছে। অথচ এটা সাতক্ষীরা ও কলারোয়ার এক বড় অংশের পানি নির্গমনের পথ। এ নদীটি প্রশস্তকরণ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সন্নিহিত বিলের পানি নিষ্কাশনের সুযোগ করা সম্ভব। সাতক্ষীরা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়েরের খাল। আগে এটি একটি নদী ছিল। স্বাধীনতার পরও এ নদীতে নৌকা ও  লঞ্চ চলেছে। দখল করতে করতে বর্তমানে এটি বড় একটি নর্দমায় পরিণত হয়েছে।

উপরোক্ত নদী ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আরো অনেক নদী রয়েছে যেগুলো হয় ভরাট হয়েছে, না হয় ভরাট হচ্ছে। আবার অনেক নদী ভবিষ্যতে পলিভরাট হতে পারে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পলিভরাট প্রক্রিয়া উপকূলীয় নদ-নদীর স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিবেচনায় আমরা যেন ভরাট নদী স্থায়ী বন্দোবস্ত না দিই। তার ওপর স্থায়ী অবকাঠামো গড়ার অনুমতি না দিই। কারণ নদী ভরাট হলে তা পুনরুদ্ধার করে কাজে লাগানো সম্ভব। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল। সবচেয়ে বড় কথা, জনপদের যে নিষ্কাশন সুবিধা তা প্রবহমান রাখতে উপকূলীয় এ নদীগুলো খননের মাধ্যমে হলেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে জলাবদ্ধতা গ্রাস করতে থাকবে।

এস এম আতিয়ার রহমান

জনসংযোগ কর্মকর্তা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads