• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শ্রমিক অধিকার আদায়ের দিন

  • প্রকাশিত ০১ মে ২০১৮

১ মে, মহান মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিতে শহীদদের স্মরণ ও তাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে ‘মে দিবস’। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় ও অধিকার ফিরে পাওয়ার দিন ১ মে।

বিশ্বের প্রায় সব দেশেই গুরুত্বের সঙ্গে দিনটি শ্রদ্ধাভরে পালিত হয়। মেহনতি মানুষের জন্য দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে তাদের দাবির পক্ষে স্লোগানে মুখরিত হয় এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন। এ ছাড়াও বাকি অনেক দেশেই দিবসটি একই দিনে বেসরকারিভাবে পালিত হয়।

১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা জমায়েত হয়েছিল। তাদের ঘিরে থাকা পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক নিহত হয়। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর পরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

বিশ্বের অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এমনকি সেসব দেশে দিনটি উপলক্ষে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতেও দিবসটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে। অন্যদিকে ‘আমেরিকা ও কানাডায় সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস হিসেবে পালিত হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিবসটি পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন, ১ মে তারিখে যে কোনো আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সেজন্য ১৮৮৭ সালেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।’ (উইকিপিডিয়া)

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি সরকারি ছুটিসহ পালিত হয়। রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন/ফেডারেশন ও সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন মে দিবস পালন করে থাকে। শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, তাদের অধিকার, মর্যাদাকে সম্মান ও সমুন্নত রাখতে প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবসে র্যালি, শোভাযাত্রা, মিছিল-সমাবেশসহ শ্রমিক গণজমায়েত করে তাদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়। হে মার্কেটের আন্দোলনরত শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে শ্রমিক ঐক্যের প্রতি সংহতি জানায়।

আজকের শ্রমিক দিবসে শ্রমের মূল্য যাতে সব শ্রমজীবী মানুষ সঠিকভাবে পায়, সেদিকে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সুনজর কামনা করছি। একাত্মতা ঘোষণা করছি মেহনতি শ্রমিকদের প্রতি, যাদের ঘামের মূল্যে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এই শ্রমিকশ্রেণির প্রতি অবহেলা ও তাদের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন আশা করা যায় না।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, নারীশ্রমিকরা শুধু বেতনবৈষম্যই নয়, তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় কর্মক্ষেত্রেই নারীসমাজকে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাতে। নারীদের পাশাপাশি শিশুশ্রমের ব্যবহারও চলছে অবাধে। যদিও কারখানা গেটে বড় হরফে লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে ‘শিশুশ্রমিক নেই/নিষিদ্ধ’। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। অবশ্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দরিদ্রতাসহ বিভিন্ন কারণে শিশুশ্রম কমছে না। কারখানা মালিকপক্ষ শিশু ও নারীদের কম শ্রমমূল্যে খাটাতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণেও শিশুশ্রম ঠেকানো যাচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে শিশুশ্রমিকদের জীবন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, অকালে ঝরে যাচ্ছে নিষ্পাপ শিশুর সম্ভাবনাময় জীবন। অনেক ক্ষেত্রে অপুষ্টির শিকার হয়েও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুশ্রমিকের জীবন। মজুরিবৈষম্যের পাশাপাশি অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার এসব শিশুশ্রমিক অপরাধী হয়ে বেড়ে উঠছে। সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হতে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই শিশুদের। বর্তমানে মেয়ে শিশুশ্রমিক ও নারীশ্রমিকদের শারীরিক লাঞ্ছনাও দুর্বিষহ করে তুলছে তাদের জীবনকে। 

আমাদের দেশে শ্রম আইন রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে শ্রমিকশ্রেণি সঠিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও জীবনমানের পরিবর্তনে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা জরুরি। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি শ্রমজীবীর অধিকার আদায়ে শুধু একটি দিবসে নয়, বরং বছরজুড়ে সোচ্চার থাকা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মহান মে দিবস সফল হোক, সার্থক হোক। জয় হোক বিশ্বের সব মেহনতি মানুষের। শ্রমের সঠিক মূল্যায়নে গতরখাটা মানুষগুলো ফিরে পাক তাদের ন্যায্য অধিকার।

 

সফিউল্লাহ আনসারী

গণমাধ্যমকর্মী

shofiullahansari@gmail.com

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads