• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শাবান মাস ও শবে বরাত

  • প্রকাশিত ০১ মে ২০১৮

হিজরি চান্দ্রমাসের অষ্টম মাস শাবান হলো বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। মোবারক মাহে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে এ মাসটি। রমজানের প্রস্তুতির জন্য এ মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শাবান মাসের বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদা বিবেচনা করে রসুল (সা.) এ মাসে সাধ্যানুযায়ী নেক আমল করেছেন এবং উম্মতগণকে এর প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন। রজব হলো উপাসনার মাধ্যমে মনের ভূমি কর্ষণের জন্য, শাবান হলো মনের ভূমি কর্ষণের পর বীজ বপন ও ফসল ফলানোর মাস আর রমজান হলো ইবাদতের পূর্ণতায় ফসল তোলার মাস।

রসুল (সা.) বলেছেন- ‘রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রমজান হলো উম্মতের মাস। রসুল (সা.) রজব, শাবান মাসের অত্যধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’-এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন এবং উম্মতকে পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। যার অর্থ হচ্ছে : হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবানের সব বরকত দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। এ মাসে রয়েছে বিশেষ ফজিলতময় শবে বরাত। শবে বরাত একটি মহিমান্বিত রজনী। এই রজনীতে আল্লাহতায়ালা তাঁর রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। পাপীদের ক্ষমা করেন। ‘শব’ অর্থ রাত আর ফার্সি ভাষায় ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য। এদিক থেকে শবে বরাত অর্থ হবে ভাগ্য রজনী। আর যদি আরবি শব্দ ‘বারাআতুন’ থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তাহলে এর অর্থ হবে মুক্তি। সুতরাং আরবিতে শবে বরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। এ রাতে আল্লাহতায়ালা পাপী লোকদের ক্ষমা করেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, এজন্য এ রাতকে শবে বরাত বলা হয়। হাদিস শরীফে এ রাতটিকে ‘নিসফে শাবান’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনী তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রি।

বিভিন্ন হাদিসে এ রাতের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়শা (রা.) বর্ণনা করেন— কোনো এক শাবানের অর্ধ রাতে রসুল (সা.)-কে বিছানায় পাওয়া যাচ্ছিল না। খুঁজে দেখা গেল তিনি জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করছেন (মুসলিম)। আরেক হাদিসে হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত রসুল (সা.) বলেছেন, যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত কর এবং পরের দিনটিতে রোজা রাখ। কেননা এ রাতে আল্লাহতায়ালা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে রিজিক দান করব। আর সুবহে সাদিক পর্যন্ত এ ডাক অব্যাহত থাকে। তাফসিরবিদদের মতে, আল কোরআনে সুরায়ে দোখানের প্রথম আয়াতগুলোতে শবে বরাতের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনায় এ রাতকে ‘লাইলাতুসসফ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং এর বরকতময় হওয়া ও রহমত নাজিল হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।

এ রাতটি বিশেষ ফজিলতময় হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ রাতে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হন। নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ, তাওবা-ইস্তেগফার করে নিজেদের পাপপঙ্কিলতা থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করেন এবং তাদের জন্য দোয়া করেন। মুসলিম উম্মাহর তিনটি স্বর্ণোজ্জ্বল যুগ তথা সাহাবা, তাবেঈন ও তবয়ে তাবেঈনের যুগেও এই রাতের ফজিলত থেকে উপকৃত হওয়ার বিশেষ গতি ও গুরুত্ব ছিল। সেই যুগের মানুষেরাও এই রাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করেছেন। এই রাতে দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকা ও ইবাদত করা সওয়াবের উসিলা হিসেবে গণ্য হবে নিঃসন্দেহে। কোনো কোনো হাদিসের আলোকে শাবানের পনেরো তারিখের রোজা অর্থাৎ বরাত রজনীর পরের দিন নফল রোজা রাখা অনেক সওয়াবের কাজ। এই রাতে আরেকটি আমল রয়েছে, যা একটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। নবী (সা.) এই রাতে একবার জান্নাতুল বাকিতে গিয়েছিলেন। যেহেতু নবী (সা.) জান্নাতুল বাকিতে গিয়েছিলেন এই রাতে, তাই মুসলমানরাও এই রাতে কবরস্থানে যাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। নবী (সা.) থেকে যে কাজটি যেভাবে এবং যে স্তরে প্রমাণিত, সেটাকে সে স্তরে রাখাই বাঞ্ছনীয়। সেই সীমারেখা অতিক্রম করা কিছুতেই উচিত নয়। এই রাতের বিশেষ কোনো ইবাদত ও ইবাদতের বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। নেই নামাজের কোনো নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা, ভিন্ন কোনো পদ্ধতি। এই রাতে যেসব ইবাদত করা হবে সবই নফল ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। আর নফল ইবাদত নীরবে আপন আপন ঘরে একাগ্রচিত্তে করা উত্তম। তবে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত ইবাদতের স্থান হিসেবে মসজিদে সমবেত হয়ে গেলে কোনো আপত্তির কারণ নেই।

এই রাতে যতটুকু ইবাদতের তাওফিক হবে, করে নেওয়া চাই। তবে এই রাতে হালুয়া-রুটি ইত্যাদি পাকানোর যে আয়োজন করা হয়, তার সঙ্গে যে শবে বরাতের কোনো ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, সে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তা ছাড়া এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেকে অজ্ঞতাবশত পাপিষ্ঠ শয়তানের প্ররোচনায় গোনাহের কাজে লিপ্ত হন। যেমন— পটকাবাজি, আতশবজি, আলোকসজ্জা করা, কবরে বাতি জ্বালানো, কবরে গিলাফ বা চাদর টানানো, মাজারে ভক্তি করা, কবরে সেজদা দেওয়া ইত্যাদি। এগুলোর কোনো ফজিলত, বরকত তো নেই-ই, বরং এগুলো কুসংস্কার ও গোনাহের কাজ। এসব কুসংস্কার পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। উপাসনায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সচেতন হতে হবে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যেন ইবাদত বিফলে না যা। আমাদের ইবাদত হোক সহিহ শুদ্ধ ও ইহ-পরকালীন কল্যাণময়।

মাওলানা আবদুল হামিদ

শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, সিলেট

hamidsylbd@gmail.com

         

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads