• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ফারাক্কা বাঁধ প্রসঙ্গে কিছু কথা

  • প্রকাশিত ০৩ মে ২০১৮

অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রশ্নে ইতোপূর্বে বাংলাদেশে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। ইস্যুটি দীর্ঘদিন চাপা থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশের খবর পত্রিকার শিরোনামের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় আলোচনায় এসেছে। শিরোনামটি ছিল ‘মরুভূমির পথে নদীবহুল নড়াইল’। এ ছাড়াও বছর দেড়েক আগে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও সমালোচনা অব্যাহত ছিল। ফারাক্কা বাঁধটি যে বিহার প্রদেশের জন্যে একটি মরণ ফাঁদ সেটি স্পষ্ট হয়েছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। দেরিতে হলেও মুখ্যমন্ত্রী উপলব্ধি করতে পেরেছেন ফারাক্কা বাঁধের কুফলের বিষয়টি। একতরফা নদী শাসন যে সুফল বয়ে আনে না, তার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করে ফারাক্কা বাঁধটি স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করেন। তিনি আরো জানান, ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গায় বিপুল পরিমাণ পলি জমেছে, যার ফলে বিহার প্রতিবছর বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমরাও একমত না হয়ে পারিনি। ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুধু বিহারই নয়, বাংলাদেশও বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত জল বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবাহিত না হওয়ায় নদীগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ছে এবং তারই প্রভাবে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ ছাড়াও ফারাক্কা বাঁধের কারণে ইতোমধ্যে মধুমতী, নবগঙ্গা, চিত্রা, কাজলা, নলিয়া ও আঠারোবাঁকি নদীতে জলপ্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। মূলত জলের উৎসমুখে পলি ও বালি জমতে জমতে ভরাট হয়ে নদী শুকিয়ে আসে। এসব নদীর জলপ্রবাহ আর কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন। উল্লেখ্য, ফারাক্কা বাঁধটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। বাঁধটি ১৯৬১ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। এটি দৈর্ঘ্যে ২,২৪০ মিটার লম্বা এবং গেটের সংখ্যা ১০৯টি। যার ফলে ভারত ইচ্ছেমতো গঙ্গার জল যেমন আটকে রাখতে পারে তেমনি ছেড়েও দিতে পারে। অর্থাৎ ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার ফলে মর্জিমাফিক পানি বণ্টন করার সুযোগ হয়েছে ভারতের।

বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ বিষয়ে বিশ্বের পরিবেশ বিশেষজ্ঞদেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তারা সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছেন। মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানী ড. নরম্যান ম্যাকলিয়ও, যিনি সাহারা মরুভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন; তিনি জানিয়েছেন, ‘সাহারা মরুভূমি শুরু থেকে যেভাবে মরুকরণের দিকে এগিয়েছে, ঠিক একই কায়দায় বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাতাসেও সাহারা মরুভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে।’ মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানীর দেওয়া এ তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চল ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আন্তরিক সহযোগিতার কথা আমরা ভুলতে পারিনি, পারা উচিত নয়। সেই বন্ধন রয়েছেও অদ্যাবধি। সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে কখনো কৃপণতা বোধ করেনি এ দেশের মানুষ। এমনকি যেকোনো কাজেই এ দেশের মানুষ ভারতে ছুটে যায়। পূজা-পার্বণে কিংবা ঈদের ছুটি কাটাতেও যান অনেকে। কিংবা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়লেও সর্বপ্রথম ভারতে যাওয়ার কথাই মনে পড়ে।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানকে ঘৃণার দৃষ্টি নিয়েই দেখেন এখনো। যা আরো প্রবল হচ্ছে হাল আমলে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্ম ’৭১-এর চেতনা বুকে নিয়ে পাকিস্তানের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষী হয়ে উঠেছেন। যা মানতে পারছেন না কিছু পাকিস্তানপন্থি বা ভারত বিদ্বেষী। সেই তারাই এখন তরুণদেরকে বাগে আনতে বোঝাচ্ছেন ফারাক্কা বাঁধের কুফলের কথা। যাতে করে কিছু কিছু তরুণ ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছেন। এতে তারা ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠছেন। যা আমাদের কাম্য নয়, আমরা চাই একটি বন্ধু রাষ্ট্র সম্পর্কে যেন জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি না হয়। ভারত যেন তা বুঝতে সক্ষম হয়। সেই বিষয়টি পর্যালোচনা করে ভারত সরকার যেন ফারাক্কা বাঁধের বিষয়ে নমনীয় হয়, সে দাবিটুকু রাখছি আমরা। দাবি রাখছি, যেন বাঁধটি স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেয় ভারত সরকার। তাতে করে বাংলার মানুষের হূদয়ে স্থায়ী আসন গাড়ার সুযোগ পাবে ভারত। তাহলে সার্থক হবে দু’দেশের বন্ধুত্বের বন্ধন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ের সহায়তাটাও স্মরণে আসবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। ছিটমহলের মতো ফারাক্কা সমস্যার সমাধান ঘটাতে ভারত সরকার এগিয়ে এলে সেটা হবে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচায়ক।

 

আলম শাইন

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ

alamshine@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads