• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

চরের বুকে চাষাবাদ

  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০১৮

বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর উৎসমুখ প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বড় দুটি নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা, পদ্মা থেকে জন্ম নেওয়া শাখা-প্রশাখা নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে বর্ষা মৌসুমের দুই-তিন মাস ছাড়া সারা বছরই নদীগুলোতে পানির অভাবে খাঁখাঁ অবস্থা বিরাজ করে। এক সময়ের প্রমত্ত নদ ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন। এসব নদীতে যখন কমবেশি সারা বছরই পর্যাপ্ত পানি থাকত, তখন মৎস্যজীবী, নৌকার মাঝিমাল্লাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করত নদীর ওপর। আজ কিন্তু সেসব অতীত। এখন প্রতিটি নদী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জন্ম নিয়েছে বিস্তৃত বালুচরের। এই চরকে ঘিরে নদী অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিরা নদীর বুকে ধানসহ নানা জাতের সবজি চাষ শুরু করেছে। নদীতে পানি না থাকায় সেচভিত্তিক চাষাবাদের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে, যা মোকাবেলা করতে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে হবে। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় একটি সমস্যা। আবার নদীতে পানি না থাকায় মানুষের জীবন ও জীববৈচিত্র্য এখন অনেকটাই হুমকিতে পড়েছে। যার বিরূপ প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত যেমন- অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এরপরও মানুষকে প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাঁচতে হচ্ছে।

নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকায় একসময় কেউ মাছ ধরত, আবার কেউ কেউ নৌকাকেন্দ্রিক উপার্জন করে সংসার চালাত। আজ কিন্তু সেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে, যা আগেই বলেছি। কিন্তু নদীকেন্দ্রিক এসব মানুষ এখন চরের বুকে চাষাবাদ করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। জন্ম নিয়েছে নদীচাষির। তারা নদীর সুবিশাল চরের নিচু জায়গায় বোরো, কাউনের চাষ করছে। আর উঁচু চরে কুমড়া, তরমুজ, আলু, ভুট্টা চাষ করে নিজেদের সংসার চালাচ্ছে। শুধু সংসার চালানোই নয়, অনেক প্রান্তিক চাষি স্বাবলম্বী হচ্ছে। জন্মসূত্রে আমার বসবাস কুড়িগ্রাম জেলায়। দেশের পশ্চাৎপদ জেলা কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য ও ভূমিহীন মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এ জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে চিলমারী উপজেলার চরের সংখ্যা অনেক বেশি। চিলমারী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটি অনেক আগেই খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়েছে। বাকিগুলোরও অংশবিশেষ নদীগর্ভে চলে গেছে। উপজেলা সদরের পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধ করা সম্ভব না হলে হয়তো এতদিনে উপজেলার শেষ চিহ্নটুকু নিঃশেষ হয়ে যেত। এই নদের জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন এনজিও’র আর্থিক সহযোগিতায় নদীচাষিরা জোটবদ্ধভাবে কুমড়া, স্কোয়াশ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের গাইবান্ধা অংশে ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে এ বছর ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। ভুট্টাচাষিরা চরের বুকে ভুট্টার চাষাবাদ করে পাকা ভুট্টা এখন ঘরে তুলছেন। যেহেতু স্বল্প পানিতে এবং বালুময় জমিতে ভুট্টা চাষ ভালো হয়, সেহেতু ভুট্টা চাষ করে নদীচাষিদের ভাগ্যের পরিবর্তন আনা সম্ভব। কিন্তু বিপত্তির জায়গাটি হচ্ছে, বাড়তি ফলন হলেই আমাদের দেশের কৃষকদের কপাল পোড়ে। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে চাষিরা বঞ্চিত হন। ফলে চাষিরা লোকসানের মুখে পড়েন এবং একপর্যায়ে লোকসানি পণ্য উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটছে। আর এই শিল্পের মুরগির সুষম খাদ্য হচ্ছে ভুট্টা। কিন্তু এ অঞ্চলে পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য তৈরির ছোট-বড় কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। অতিসম্প্রতি গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে ভুট্টাচাষিদের সফলতা সরেজমিনে দেখতে যান। সেখানে ভুট্টাচাষিরা দাবি করেছেন, এ অঞ্চলে যেন পশুপাখির খাবার তৈরি উপযোগী কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করা হয়। তাহলে ভুট্টাচাষিদের ভুট্টা বিক্রির উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং ভুট্টাচাষিরা লাভবান হতে পারবেন। পরিদর্শনের সময় ফুলছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার জানিয়েছেন, এবার ফুলছড়ি উপজেলার সাত ইউনিয়নে ৪ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। বিঘাপ্রতি জমিতে ৩৫ থেকে ৪০ মণ ফলন হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ অঞ্চলে পলি ও দোআঁশ মাটির পরিমাণ বেশি, যা ভুট্টা চাষের জন্য উপযুক্ত। তিনি দাবি করেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ভুট্টাচাষিদের সঠিক পরামর্শ এবং ভুট্টাচাষিদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ এলাকায় ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরাও মনে করি, সরকারের তরফে নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হলে এবং উৎপাদিত ভুট্টার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হলে ভুট্টাচাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

ধান, চাল, গম অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে যেভাবে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য সরকার নিশ্চিত করে থাকে, তেমনি সরকার অভ্যন্তরীণভাবে ভুট্টা সংগ্রহ করলে ভুট্টার উপযুক্ত মূল্য চাষিদের নিশ্চিত হতো। কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই কৃষি খাতকে সরকার পরিকল্পিতভাবে সহায়তা দিলে আগামী দিনে শুধু কৃষি চাষাবাদ করে দেশের চাহিদা মেটানোর পরও উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। বিশেষ করে নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা নতুন নতুন চরে চাষাবাদের যে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে, সে দুয়ারকে প্রসারিত করতে পারলে ভুট্টাচাষের পাশাপাশি নানা জাতের সবজি উৎপাদন সম্ভব। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে গোটা বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, বাড়তি ফলন হলেই চাষিদের কপাল পোড়ে। যেমন চলতি মৌসুমে টমেটো, বেগুন, আলুর বাড়তি ফলনের কারণে উপযুক্ত মূল্য থেকে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সংরক্ষণ উপযোগী পর্যাপ্ত হিমাগার নির্মাণ করা। উল্লেখ্য, সরকার খাদ্যশস্য উৎপাদনে যতটা সহায়তা কিংবা প্রণোদনা দিয়ে থাকেন, উৎপাদন-পরবর্তী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সে ধরনের সহায়তা বা প্রণোদনার উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে চাষিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষাবাদ করলেও ক্ষতির মুখে পড়ে। কোনোভাবেই এ অবস্থা কৃষির সমৃদ্ধির জন্য অনুকূল নয়। এ অবস্থায় যা জরুরি তা হচ্ছে, প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার সরকারিভাবে নির্মাণের জন্য থোক বরাদ্দ রাখতে হবে। পর্যায়ক্রমে সবজি উৎপাদন অঞ্চলে হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। তাহলে চাষিরা টমেটো, শিম, করলা, বেগুন, কুমড়া, লাউসহ অন্যান্য সবজি স্বল্প ভাড়ায় হিমাগারে সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে, যা চাহিদা অনুযায়ী হিমাগার থেকে উত্তোলন করে দেশীয় চাহিদা পূরণের পর বাড়তি সবজি প্রয়োজনে বিদেশে রফতানিও সম্ভব হবে। সরকার নিকট ভবিষ্যতে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে এ ধরনের পরিকল্পনা যাতে গ্রহণ করে, সেটাই চাষিদের দাবি। সরকার চাষিদের ভাগ্য পরিবর্তনে সময়োপযোগী পৃষ্ঠপোষকতা দিলে বর্গাচাষি, প্রান্তিক চাষি, নদীচাষিসহ সব চাষির উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য যেমন একদিকে নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে কৃষি খাতের সমৃদ্ধি ও বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।

আবদুল হাই রঞ্জু

সমাজসেবী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads