• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

যারা খাবারে বিষ মেশায় তারা মানুষ খুনি

  • প্রকাশিত ০৫ মে ২০১৮

দেশে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রীর অবাধ ব্যবহারে বছরে দ্বিগুণ হারে বিভিন্ন মরণব্যাধি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মরণব্যাধি মহামারী আকার ধারণ করবে বলে তাদের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিডনি, লিভার, শিশু, গাইনি ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সময় থাকতে ভেজাল খাদ্যসামগ্রীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এসব খবর নিত্যদিন জানতে পারছি পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে। বিস্ময়ে, ভয়ে, আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসছে। এক তথ্যে জানা গেছে, বাজারে প্রচলিত পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর শতকরা ৯৬ ভাগই বিষাক্ত এবং খাবার অযোগ্য। তাহলে কী খেয়ে বেঁচে আছি আমরা! পত্রিকার খবরে জানতে পারি, প্রতিবছর দ্বিগুণহারে হাবা-গোবা ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্যসামগ্রী। গর্ভাবস্থায় বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী খাওয়ার কারণে মা ও তার পেটের সন্তানটি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৯৯ ভাগ। দেশে বছরে ২ লাখের অধিক লোক নতুন করে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে (সূত্র : বারডেম)। ডায়াবেটিস রোগী ব্যাপক হারে বৃদ্ধির জন্য ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত। কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে- ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত রঙ মেশানো লাল আটা, চাল ও আলুসহ নানা ধরনের লোভনীয় ফাস্টফুড এ রোগের প্রধান উৎস। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তারাই এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশুদের তুলনায় কিছুটা বেশি হওয়ায় বড়দের কিডনিতে তা ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলছে। ফরমালিনযুক্ত দুধ পান করলে শরীরে হাড়ের জোড়ার দূরত্ব সৃষ্টি ও ব্যাকপেইনসহ শারীরিক বিভিন্ন জটিল সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুদের নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পেতে পারে। এসব বিষাক্ত সবজি, ফলমূল, মাছ, দুধসহ অন্যান্য খাবার খেয়ে আয়ু কমছে আমাদের। এসব খাওয়ার ফলে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন বিষাক্ত খাবার খাওয়ার ফলে মেধাশূন্য হতে পারে আগামী প্রজন্ম! আহা, কী ভয়ঙ্কর! এ কেমন সমাজে বাস করছি আমরা, যেখানে মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধ চরমভাবে লাঞ্ছিত। বিবেক যেখানে অর্থের কাছে সমর্পিত। আমাদের প্রিয় সন্তান, পিতা-মাতাসহ আপনজনদের সুস্বাস্থ্য আর সুস্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় প্রতিদিন যেন বিষের পেয়ালা তুলে দিচ্ছি তাদের মুখে। যা ভক্ষণ করে আমরা তিলে তিলে খুন হচ্ছি; খুন করছি তাদের জীবনীশক্তিকে। আমাদের নৈতিক স্খলন কী এতই নিচে নেমে গেছে! বিবেক বলে কি আমাদের কিছুই নেই! তাহলে আমরা নিজেদের মানুষ দাবি করব কোন অধিকারে? লাভটাই কী আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়!

আমরা কী খেয়ে আসছি এতদিন? কীভাবে বেঁচে আছি?  ভেজাল খাবারে বিষক্রিয়ার পরিণতির কথা ভাবলে মনে হয়- এভাবে খাবারে বিষ মিশিয়ে আমাদের তিলে তিলে না মেরে— একসঙ্গে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলাও অনেক ভালো! সন্ত্রাসীরা যেভাবে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে জীবন কেড়ে নেয়- এই হত্যাকাণ্ড আর খাবারে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার মধ্যে কোনো তফাত আছে কি? অতএব, যারা খাবারে বিষ মেশায় তারা মানুষ খুনি। তারা প্রজন্মের শত্রু! যারা খাদ্যদ্রব্যে বিষ মেশায় তাদের শুধু জেল-জরিমানা নয়; সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়ে দ্রুত আইন চালু করা হোক। তাদের সামাজিকভাবে এমন অপদস্ত করা হোক যাতে পরিবারে তাদের স্ত্রী-সন্তান ও সহোদররাও যেন ধিক্কার দেয়। সমাজের মানুষ যেন তাদের ছি ছি করে। এ শুধু আক্ষেপ নয়, ক্ষোভ, ক্রোধ এবং প্রার্থনা আমাদের।

বাজারে যেসব খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয় তার মধ্যে কত প্রকারের খাবার ও খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল হচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ভেজালবিরোধী অভিযানে জানা গেছে, রাজধানীর খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে সাধারণ খাদ্যদ্রব্য চাল, ডাল, আটা, মুড়ি থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য গুঁড়োদুধ, পাস্তুরিত তরল দুধ, দই, আইসক্রিম, চকোলেট, জুস, জেলি, কোল্ডড্রিঙ্কস, মিষ্টি, ঘি, হোটেলের খাবার, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, মুরগি, ওষুধ, জর্দা, খাবার ওরাল স্যালাইন, ভোজ্যতেল, বেকারির খাদ্যসামগ্রী ও বিদেশি কসমেটিকসহ শতাধিক রকমের পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল খুঁজে পেয়েছেন। জানা গেছে, ডাই ব্যবহার করার ফলে নুডলস ও বিস্কুট মচমচে থাকে এবং স্যাঁতসেঁতে হয় না। দেশের অধিকাংশ খামারে গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ও খাবার সোডা। এর ফলে গরু দ্রুত মোটাতাজা হলেও এর মাংস মানুষের শরীরে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও লিভার ও কিডনি ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষকদের মতে, বিষাক্ত নকল ট্যাং ও চকোলেট খেলে শিশু বা বয়স্ক যে কোনো মানুষের দ্রুত কিডনি নষ্ট, ক্যান্সার, লিভার ব্যাধি, দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, শিশুদের হার্টের রোগ ও দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে পারে। চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারকে সুস্বাদু করতে মাত্রাতিরিক্ত টেস্টিং সল্ট ব্যবহার মানুষের শরীরের জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে গর্ভজাত শিশু বিকলাঙ্গ এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে।

আমরা এখন কী করব? খেয়ে-পড়ে তো আমাদের বাঁচতে হবে। এখন বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতার। ভেবে-চিন্তে, বুঝে-শুনে খেতে হবে। বাহিরের খাবার যথাসম্ভব কমিয়ে এবং এড়িয়ে যেতে পারলে ভালো। ফাস্টফুড যত কম খাওয়া যায় তত ভালো। যতটা সম্ভব বাসায় তৈরি খাবার খেতে হবে। আর সবিনয় অনুরোধ আপনার সন্তানকে বাজারের কেনা খাবার না দিয়ে বাসায় তৈরি করে খেতে দিন। এতে অন্তত ভেজালের মারাত্মক দূষণ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবেন। ব্যবসায়ী সমাজ, উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতাদের সচেতন করতে হবে যে— এই কাজটি একটি বড় রকমের অন্যায়, পাপ এবং এটি একটি রাষ্ট্রীয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, কৃষকরা যেন কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে অথবা কম ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয়। তারা যেন প্রাকৃতিক পদ্ধতি যেমন- গোবর, ছাই এবং বাড়ির আবর্জনা দিয়ে কম্পোস্ট সার জমিতে ব্যবহার করেন। নিজে বাঁচতে এবং প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে এখন থেকেই প্রয়োজন জনসচেতনতার সৃষ্টি, সরকারি উদ্যোগ, কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা। তবে ভেজালকারীদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, আপনি যে জিনিসটায় ভেজাল মেশাচ্ছেন এর বাইরে বাকি সব জিনিস আপনিও তো কিনে খাচ্ছেন, তাহলে আপনি কতটা নিরাপদ? কতটা নিরাপদ আপনার সন্তান?

 

এস এম মুকুল

প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads