• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বরাত

  • আবদুল মতিন খান
  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৮

বাংলায় বরাত শব্দের অনেক অর্থ আছে। আরবি থেকে গৃহীত এই শব্দ বাংলায় যেসব অর্থে ব্যবহূত হয় তার মধ্যে ভাগ্য সম্ভবত মুখ্য বা প্রথম। বাঙালি জাগ্রত অবস্থায় বহুবার উচ্চারণ করে থাকে, বরাতের ছিল না বা বরাতে ছিল-তাই এমনটা (মন্দ কিংবা ভালো) হয়েছে। বাঙালি জীবনের সবটাই বরাত বেষ্টিত। হয়তো মনুষ্যজীবনেরও। কারো বরাত খোলে, কারো হয় বন্ধ। কেবল মানুষ নয় এ কথা সব প্রাণী সম্পর্কেই বলা চলে। এটা সত্য ধরে নিয়ে বাঙালি আরবি বছরের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে বরাত বলে। সেদিন অনেকেই উত্তম খানাপিনার পর সারারাত ইবাদত করে। কেউ কেউ করে ভাগ্য ভালো করার জন্য। উভয় দলের উদ্দেশ্য অভিন্ন- ভাগ্য ভালো করা।

ব্যাপারটা একান্তই বঙ্গজ। শবে বরাত বলে ধর্মের একটি বিধান আছে, বাংলার বাইরের কেউ জানে না। বাংলায় এ প্রথাটি প্রচলিত হওয়ার কারণ এই হতে পারে যে, বাঙালি উৎসবপ্রিয় একটি জাতি। বাংলায় আছে বারো মাসে তেরো পার্বণ। ধর্ম পালনেও বাঙালি অন্য দেশের মানুষের থেকে এগিয়ে। ইসলাম ধর্মের উদ্ভব আরব দেশে, আজকের সৌদি আরবে। সৌদি থেকে কয়েক বছর কাজ করে যারা ফিরেছেন তারা বলেন সৌদিরা ফরজ ছাড়া অন্য নামাজ আদায় করে না। প্রথম যারা সৌদি আরব গিয়েছিলেন তারা হতবাক হয়ে যান এই দেখে যে, সৌদিরা দুই ঈদে কোনো উৎসব করে না। ঈদুল ফিতরের দিন তারা ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদে বসে থাকে। সূর্য কোমর সমান উঠলে দু’রাকাত ঈদুল ফিতরের সালাত আদায় করে বাড়ি ফিরে যায়। ঈদুল আজহার দিনও তাই করে, তবে যার সামর্থ্য থাকে সে একটি ভেড়া কোরবানি দিয়ে বাড়ি যায়। বছরের পর বছর কোরবানি দেওয়া পশু মাঠে শুকিয়ে অথবা পচে নষ্ট হতো। পাকিস্তান সরকার সৌদি সরকারকে পশুর চামড়া ছিলে মাংস ফ্রিজ করে দরিদ্র মুসলমান দেশগুলোর দরিদ্রদের খাওয়ার জন্য পাঠাতে অনুরোধ করলে তারা কোরবানির মাংস পাঠাতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানেও সে মাংস আসে। আসা মাত্র সে মাংস জেলায় জেলায় পাঠালে জেলার বড় কর্তারা তা সাবাড় করেন। বাংলাদেশ আমলে এর অন্যথা হচ্ছে, এমন মনে হয় না। গরিবের কিসমত সর্বত্র সমান। কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। গরিবের বরাত থাকবে গরিবের সঙ্গে, ধনীর থাকবে ধনীর সঙ্গে। গরিবকে উদয়াস্ত খেটে পেটের ভাত সংগ্রহ করতে হয়। ধনী শুয়ে বসে তার বিরিয়ানি ফিরনির ব্যবস্থা করে।

উৎসব কী আরবরা জানতই না। কাজের জন্য লাখ লাখ বাঙালি সৌদি আরবে যায়। তারা দেখতে পায়, ঈদে কোনো ছুটি নেই। ঈদের নামাজ ব্রেক ফাস্টের আগেই হয়ে যায়। কাজেই সকালের নামাজ সেরে কাজে যেতে অসুবিধা কোথায়? বাঙালি কর্মীরা সৌদিদের এই নিয়ম মানতে নারাজ। তারা দেশের নিয়মে সৌদিতেও নতুন জামা-কাপড় পরে নামাজ শেষে আনন্দ-উল্লাস করতে চায়। সৌদি মনিব এতে বাধা দিতে গিয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। কিন্তু বাঙালিকে থামাতে পারে না। বাঙালি সেদিন ভালো খাবার খায় এবং হৈহুল্লোড় করে দিন কাটায়। কেবল বাঙালি নয়, পাকিস্তান ও ভারত থেকে যারা গেছে তারাও তাই করে। আনন্দ হলো সংক্রামক, আগের দিনের কলেরা-বসন্তের চেয়েও। সৌদিরা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বিদেশিদের অনুকরণ করতে থাকে। তবু সে দেশে ওয়াহাবিপন্থিরা ক্ষমতাসীন থাকায় আনন্দের ঢেউ বেশি হতে দেয় না। হালে বাদশা সালমান ক্ষমতা দখলের পর তিনি তার সমাজকে দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছেন। নারীরা অনেক নাগরিক অধিকার যেমন- ড্রাইভ করা, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখা- এসব উপভোগ করছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল কল্পনাতীত। বাদশা সালমান সমুদ্রতীরে একশ’ এক তলা একটি ভবন তৈরি করছেন, যাতে হেন বিনোদন-উপকরণ নেই, যা থাকবে না। বিশ্বের সর্বপ্রান্তের অধি- কোটিপতিরা টাওয়ারটিতে গিয়ে তাদের শখ ও সুখ মেটাবেন। বিদেশি মুদ্রা অর্জনের বর্তমানের একমাত্র উৎস খনিজ তেলের ওপর নির্ভরতা কাটাতে তিনি এই প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এরপর হয়তো আরো নেবেন। তিনি যে উদ্ভাবনশীল চিন্তার মানুষ, তা বোঝা যায়। এ জন্যই তাকে মেরে ফেলতে রক্ষণশীলরা তার প্রাসাদে হামলা চালিয়েছিল, যা ব্যর্থ হয়েছে। তার বরাতের জোর আছে বলতে হবে।

হিজরি সাল চাঁদ ওঠা দিয়ে গণনা করা হয়। চান্দ্রমাস হয় ঊনত্রিশ দিনে। আরব দেশগুলোর আকাশ সাধারণত মেঘমুক্ত। মেঘ এলেও বৃষ্টি ঝরিয়ে দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এ জন্য আরবরা চাঁদের ওঠা-ডোবা দিয়ে দিন গণনা করে। ফলে মাস হয় ঊনত্রিশ দিনের। এক দিন কম হওয়ায় আরবি সাল প্রতিবছর এগারো দিন করে এগিয়ে আসে। এর কারণ হলো, অমাবস্যার দিন চাঁদ না থাকায় দিনটি বাদ যাওয়া। হিজরি সাল অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগি হওয়ায় মুসলমানরা জীবনে সৌর বছরের প্রতিমাসেই ঈদ, রোজা বা সিয়াম পালন করতে পারে। তবে গ্রীষ্মে রোজা পড়লে মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলের মানুষের সিয়াম পালন খুব কষ্টের হয়। নরওয়ে সুইডেনে গ্রীষ্মে দিন হয় ২২ ঘণ্টার। ওইসব দেশে বসবাসকারী বাঙালি তাদের রোজার কষ্টের কথা বলেছেন। ভাগ্যিস মেরু অঞ্চলে কোনো মুসলমান নেই। সেখানে ছ’মাস দিন ও ছ’মাস রাত। এসকিমো কেউ মুসলমান হলে তাকে মধ্য ইউরোপে নামাজ-রোজার জন্য চলে আসতে হতো।

পয়লা মে বিশ্ব শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা দিবসে এবার পড়েছে লাইলাতুল বরাত অর্থাৎ সৌভাগ্যের রজনী। মুসলমান শ্রমিক দিনভর তার ন্যায্য প্রাপ্যের জন্য লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল-মিটিং শেষে ঘরে পৌঁছে গোসল সেরে পাকসাফ হয়ে বসে পড়েন জায়নামাজে। যতক্ষণ তার শরীরে কুলোয় ততক্ষণ তিনি ইবাদত বন্দেগিতে থাকেন মশগুল। ভাগ্য বা বরাত বদলাবার অর্থাৎ উন্নত করার সেটা একটা জেনুইন প্রয়াস। তাতে কেউ কেউ ফল পান। তবে অধিকাংশের বরাত একই থাকে কিংবা যায় নেমে।

বরাতের ব্যাপারে বাংলাদেশের জন্য আছে সুখবর। বাঙালি ছিল গরিব। জাতিসংঘ থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল ধাপে পৌঁছেছে। এর পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তার আছে ভিশন বা দূরদৃষ্টি- যা আর কোনো রাজনীতিকের নেই। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ঘোষণা দেন এবং কাজ শুরু করেন দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের ও ২০৫০ সালের আগে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করতে। সূচি অনুযায়ী যে কাজ হচ্ছে তার চাক্ষুষ প্রমাণ কুঁড়েঘরের দেশ বাংলাদেশের আজ আর কোথাও কুঁড়েঘর নেই। সর্বত্র টিনের ঘর অথবা দালান। প্রশস্ত চার লেনের সড়ক ও তাতে সংযোগস্থলে ফ্লাইওভার বসিয়ে অবিরাম চলাচল নিশ্চিত করা হয়েছে। তবু সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রী ও পথচারী নিহত হওয়ার সংখ্যা ক্রমাগত যাচ্ছে বেড়ে। এর জন্য শনাক্ত করা হয়েছে অদক্ষ অশিক্ষিত ড্রাইভারদের। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে অনেক টেস্টে উত্তীর্ণ হতে হয়। এর জন্য ট্রাফিক আইন ও অন্যান্য কতিপয় আইন এবং মোটরযানের ইঞ্জিন সম্বন্ধে যাবতীয় জ্ঞান রপ্ত করতে হয়। তারপর হয় পরীক্ষা। পরীক্ষায় পাস করলে তবে মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স। কিন্তু বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অশিক্ষিত ও মূর্খরা টাকা খরচ করে লাইসেন্স পায়। এরা ড্রাইভিংয়ের কিছু জানে না শুধু স্টিয়ারিং ধরা ছাড়া। বাংলাদেশের যাত্রীদের বরাত খারাপ। লাইলাতুল বরাতে সারা রাত উপাসনা করেও পরে কোনো একদিন বাসে উঠলে বেপরোয়া ভুয়া চালকের কারণে তার মৃত্যু হতে পারে। এই অপ্রত্যাশিত অপমৃত্যু তার বরাত ছাড়া আর কী?

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads