• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

বিনা যুদ্ধে নাহি দিব

  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০১৮

পূর্বকাল থেকেই জ্ঞানী-গুণীরা বলে আসছেন যে, দুটি জিনিস এ দুনিয়ায় ভারি গোলমেলে। এক. টাকাপয়সা, ধনদৌলত আর দুই হলো নারী। সুতরাং, ওহে মানবজাতি, তোমরা দুটি বস্তু সম্পর্কে সাবধান থাকিও। ধন-সম্পত্তি বস্তু- এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু নারীকে ‘বস্তু’ রূপে অভিহিত করা সেই প্রাচীনকালে সম্ভব হলেও আজকের দিনে রমণীর বস্তুরূপ কল্পনা করাও অসম্ভব। নারী প্রগতির এই যুগে আমরা তাদের অবশ্যই অবশ্যই ‘বিষয়’ বলে উল্লেখ করতে পারি। আশা করি ‘পুরুষ বিষয়ক’ শব্দ লেখা বা বলা গেলে ‘নারী বিষয়ক’ও বলা যাবে।

আমাদের মহল্লার প্রখ্যাত জ্ঞানী মুজবুক খানদার ইতিহাসের বিভিন্ন অলিগলি ও ফাঁকফোকর ঘুরে এসে আবিষ্কার করেছেন যে, জগতের সকল যুদ্ধ (এর মধ্যে গোলমাল, মারামারি, হাতাহাতি, খুনটুন সবই ধরা হচ্ছে) কেবল দুটি কারণে সংঘটিত হয়েছে : হয় নারীসংশ্লিষ্ট কোনো জটিল সমীকরণ, না হয় ধনসম্পত্তির ঝুট-ঝামেলা। মহারূপসী হেলেন দেবীকে নিয়ে ট্রয়ের সেই কুখ্যাত যুদ্ধের কথা মহাকাব্যে অমর হয়ে আছে। সীতা দেবীকে ফাঁকি দিয়ে শ্রীমান রাবণবাহাদুর রথে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেলে স্বামী রামের সে কী প্রচণ্ড ক্রোধ। পুরো লঙ্কা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একেবারে ছাই করে ছাড়লেন। এখানে নারীকে অভিযুক্ত করার কোনো কারণ আছে বলে আমাদের মনে হয় না। কেননা, উভয় ক্ষেত্রেই, মানে হেলেন ও সীতা দু’জনেই পুরুষের হিংসা-প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছেন।

যাই হোক, আমরা নারী-পুরুষের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কোনো মতামত দিতে আসিনি তবে পুরুষেরা যে বড় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে ভালোবাসে- তা নিয়ে আশা করি কেউ (নারী-পুরুষ দু’পক্ষই) ভিন্নমত হবেন না। আমাদের পুরুষকুল বড়ই যুদ্ধপ্রিয়। নারী নিয়ে যুদ্ধের দুটি উদাহরণ দিয়েছি। এরকম হাজার হাজার রমণীস্পৃষ্টহেতু পুংযুদ্ধের ঘটনা ও দুর্ঘটনা জগৎময় ছড়িয়ে আছে।

ধনদৌলতের যুদ্ধ তো মান্ধাতার আমল থেকেই চলছে। অমুক রাজার কাছে অমুক রাজা কর চেয়ে পত্র পাঠালেন। পত্রপ্রাপক রাজা পিঠ সোজা করে জানিয়ে দিলেন, একটি টাকাও কর দেব না। এত বড় সাহস, আমার কাছে কর চাওয়া! এবার শুরু দুই রাজার যুদ্ধ। চাহিবামাত্র প্রদান করিলে হয়তো যুদ্ধ-বিগ্রহের কোনো কারণ ঘটত না। যুদ্ধের খরচাপাতিও কিন্তু একেবারে কম নয়। শোনা যায়, আলিবর্দী খান কর না দেওয়ার জন্য দশ বছর মারাঠি বর্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর নাকি হিসাব করে দেখেছিলেন দশ বছরে যে পরিমাণ টাকা বর্গিদের দিতে হতো, তার চেয়ে যুদ্ধের খরচ হয়েছে অনেক বেশি।

সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে আবার এক দেশ অন্য দেশটি পুরোপুরি দখল করে মালিক হয়ে যায়। ব্রিটিশরা আমাদের ভারতবর্ষ দখল করে প্রায় দু’শ’ বছর শোষণ আর শাসন করেছে। ব্রিটিশ শোষণ নিয়ে ভারতীয়দের সে কী ক্রোধ! আরে বাপু (এখানে ‘বাপু’ বলতে গান্ধীজিকে বোঝানো হচ্ছে না), তোমাদের দেশ কেড়ে নিয়েছি তো সম্পদ লুটপাট করার জন্যই। আমাদের আর কোনো উদ্দেশ্যই নেই। ভারতে বসে বসে মশার কামড় খাওয়া আর বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য আইন তৈরি করার জন্য এ দেশে আসিনি। রেললাইন বসিয়েছিলাম তো ওই ধনসম্পদ হাতিয়ে বন্দরে নিয়ে যাওয়ার সুবিধার জন্য; ভাবিস নে আবার, তোদের শহর-বন্দরে গিয়ে ফুর্তি করার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।

সাম্রাজ্যবাদের কৌশল বদলে গেছে। এখন ওরা বড় বড় মাথাওয়ালা পণ্ডিতদের দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কায়দা-কানুন তৈরি করে। সারা দুনিয়াকে আবার ফোর্স করে ওইসব কানুন স্বাক্ষর করতে। না করে উপায় থাকে না। এই যেমন আমরা; দরজিগিরি করে কোনোমতে টিকে আছি। বড় যুদ্ধবাজদের আইন-কানুনে স্বাক্ষর না করলে হাফপ্যান্ট আর আন্ডারওয়্যারের বস্তা চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে উঠবে না। সুতরাং, আমরা টুক করে সই মেরে দিই। সবাই অবশ্য আমাদের মতো টুকটাক মেরে দেওয়া পার্টি নয়। হিসাব-নিকাশ করে, দরাদরি করে, তর্কাতর্কি শেষে চুক্তিতে সই মারে। সরাসরি জোর করে বাজার দখল তথা দেশ দখলের প্রথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বড় পক্ষ ছোট পক্ষের সঙ্গে একটা ‘রফা’ করেই বাজারে ঢুকে পড়ে। আমেরিকা বলে, আমাদের এইসব মালপত্র তোমাদের দেশে চালান দেব; কর দেব না। আমরা গরিব পার্টি চুপ করে মেনে নিয়ে বলি, স্যার, আমাদের পাটের বস্তাগুলো যদি বিনাশুল্কে...। চুপ, ব্যাটা আহাম্মক, পাটের বস্তা... নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে থাক।

চীনাদেরও এই জাতীয় একখানা ধমক মেরেছিলেন মার্কিন দেশের প্রেসিডেন্ট মহাশয়। নিজেও একজন পাক্কা ব্যবসায়ী। চীনাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কয়েকটি পণ্যে অতিমাত্রায় বেশি কর মেরে জিনপিংয়ের ছোট চোখ আরো ছোট করে দিলেন। পিংবাবুও শিং বাগিয়ে ওভারট্রাম্প মেরে দিয়েছেন। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হলো পিংপং বাণিজ্য যুদ্ধ। জিনসাহেব জিনের বোতল ছুড়ে ফেলে বলে উঠলেন, ঠিক আছে ডোনাভাই, আমার মালপত্র যদি তোমার পছন্দ না হয়, নিও না। আমিও ভায়া তোমার শুয়োরের মাংস খাব না, তোমার মদের বোতল ছুঁয়েও দেখব না। শুয়োর-মদ না খেলে যদি মরে যেতে হয়, তাও সই। মাঝখানে সুযোগ বুঝে ফুটকি মেরে দিয়েছে আরেক ব্যবসা-খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়া। চীনাদের কানে কানে বলে দিয়েছে, ভয় নেই শিং ভাই, আমাদের শুয়োর আমেরিকার শুয়োরের চেয়েও মোটাতাজা। আর মদের কথা কী বলব ভাই, তোমাদের জিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে আমাদের জিন অনেক কড়া।

ট্রাম্প আবার গলা উঁচিয়ে ঘোষণা করেছেন বাণিজ্যযুদ্ধ খুব ভালো; এ যুদ্ধ যত বাড়ানো যায়, ততই ভালো। রাজার রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। প্রাণ আর যায় কোথায়, উলুখাগড়ার তো প্রাণই নেই। বড় বড় যুদ্ধপ্রেমীদের যুদ্ধ যুদ্ধ ক্রীড়ার ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, নিহতের সংখ্যা ত্রিশ লাখ। অন্যদিকে, যুদ্ধের জন্য বেচাকেনার বৃদ্ধি কয়েক হাজার কোটি ডলার। আমেরিকার সদাশয় রাষ্ট্রপতি খুব খাঁটি কথা বলেছেন : যুদ্ধ খারাপ নয়, যুদ্ধ ভালো। যুদ্ধ না হলে আমেরিকার কামান-বন্দুক বিক্রি হবে কীভাবে! বেচা-বিক্রি না হলে অস্ত্রের কারখানা বন্ধ, অতএব, শ্রমিকের মৃত্যু। আহা, কী নিদারুণ দুঃখের কথা! গণতন্ত্রের মহান সাধকের দেশে কারখানা বন্ধের জন্য শ্রমিকের অনাহারে জীবন প্রদীপ নিভে যাবে; তা কি কখনো হয়!

হয় না বলেই যুদ্ধ চাই। যুদ্ধ নেই তো রাষ্ট্র নেই, যুদ্ধ নেই তো অর্থনীতি নেই। যুদ্ধ আছে বলেই আমি ট্রাম্প আছি, তুমি জিন আছ, মার্কেল আছ, মে আছ, পাকিস্তান আছ, ফিলিস্তিন আছ, ইসরাইল আছ। আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যুদ্ধ যুদ্ধ ভঙ্গির সমর্থকদের মধ্যে প্রায়শ যুদ্ধ লেগে যায়। যেন যুদ্ধ না হলে কোনো নির্বাচন নির্বাচনই নয়। যুদ্ধ না থাকলে সমগ্র জগৎ বুঝি নিস্তেজ হয়ে যায়। উত্তর কোরিয়াকে সহজে কেউ ঘাঁটায় না। দেশটির তরুণ নেতার সঙ্গে কেউ বুঝি যুদ্ধ করতে চায় না। আহা, বেচারি আর কী করে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ এক-দুইখানা এমন অস্ত্র ছুড়ে দেয় যে, জাপান সাগর পার হয়ে অন্য সাগরে গিয়ে পড়ে। জাপানিরা তখন যুদ্ধভয়ে কম্পমান।

বৌদ্ধশাস্ত্রে বলা হয়েছে, জগৎ দুঃখময়। আমরা বলি, জগৎ যুদ্ধময়। এ সংসার কেবল যুদ্ধে ভরা। জন্মের পর থেকেই মনুষ্য যুদ্ধ করতে করতে বড় হয়। আমাদের যুগে মায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হতো; না হলে একফোঁটা  মাতৃদুগ্ধও মিলত না। আজকাল দেখতে পাই, আমাদের মাতৃকুল সন্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বাছা আমার ঠিকমতো খায় না- মায়ের যুদ্ধ। স্কুলে যেতে চায় না- মায়ের যুদ্ধ। পড়তে বসে না- মা এবার বিদ্যালাভের রণক্ষেত্রে। সন্তান হওয়ার আগেই আমাদের জননীকুল ‘অপত্যপ্রতিপালন ও বাচ্চাবিকাশকরণ সংক্রান্ত সমরবিদ্যা’র কোর্সে ভর্তি হয়ে যান।

সেদিন এক প্রতিবাসী জননীর কাছে শুনলাম, তিনি দু’হাতে আর সবকিছু সামলে উঠতে পারছেন না। দেবী দুর্গার মতো দশখানা না হোক, চার ছ’খানা হাত হলে মন্দ হতো না। তিনি যুক্তি দেখালেন অন্তত চারটি ক্ষেত্রে তাকে সমানে যুদ্ধ করতে হয় : সংসারক্ষেত্র, স্বামীক্ষেত্র, সন্তানক্ষেত্র ও বিবিধক্ষেত্র। বিবিধক্ষেত্র বলতে তিনি অবশ্য কোন ক্ষেত্র বুঝিয়েছেন তা পরিষ্কার নয়, তবে এটা মানতেই হবে যে তিনি চতুর্ভূজা বা ষড়ভূজা হওয়ার পক্ষে একটি মোক্ষম যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

প্রেমের যুদ্ধ নাকি এক অতিশয় অপ্রচলিত ও সদাচঞ্চল কৌশলগত লড়াই। এখানে ‘জয়’ করার জন্য সবকিছু করা যায়। প্রেমে নাকি সত্য-মিথ্যার কোনো বালাই নেই; কৌশল অপ-কৌশলের কোনো নীতি-নিয়ম নেই। হূদয় জয়ের মহাসমরের যেকোনো পর্যায়ে যা দিয়ে হূদয় ফতে করা যায়- প্রেমিক-প্রেমিকা তার সবই করতে পারবেন। শাস্ত্রও তাদের একশত ভাগ ‘দায়মুক্তি’ দিয়েছে। তাদের ন্যায় সমরবিদ আপনি কোথাও পাবেন না। বিশ্বসংসারে হেন কোনো কর্ম নেই যা তারা করতে পারেন না; পরাজয় বলে কোনো শব্দ কিংবা ‘কৌশলগত হূদয়টান’ বলে কোনো কিছুই তাদের সমরশাস্ত্রে লেখা নেই। লাখ লাখ বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকা তো সেই অমর প্রেমকাব্য পড়তে পড়তে প্রণয়সমরে আত্মাহুতি দিয়ে চলছেন : হাতের মুঠোয় নিয়েছি প্রাণ, বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি একশ’ আটটি নীলপদ্ম, তবুও...।

 

সালেহ মাহমুদ রিয়াদ

রম্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads