• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

জীবনের মানে গতি, গতির মানে চাকা

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ০৯ মে ২০১৮

ঝাঁকাতে কয়েকটি কলার মোচা। পরনে লুঙ্গি, শার্ট, গলায় ঝোলানো গামছা। একজন মানুষ বসে আছে ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তার প্রথম লেনে। এ রকম মানুষ প্রতিদিনই থাকে, আজ চোখে পড়ল আলাদা করে। তার সামনে দিয়ে শম্বুক গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। তখন রাস্তা থেকে ঝাঁকাটা তিনি সামান্য সরিয়ে নিলেন। অটোরিকশাটি পেরিয়ে যেতেই আবার রাস্তায় নামিয়ে নিলেন ঝাঁকাটি। শুধু এই মানুষই নয়, আছেন আরো অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেকের কাছেই আছে কিছু না কিছু। তারা প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল-বিকাল রাস্তায় পসরা নিয়ে বসছেন। আর আশপাশে অসংখ্য মানুষ, পথচারী— তারা প্রত্যেকেই দরদাম করছেন, কিনছেন, দেখছেন। পাশ দিয়ে রাস্তায় সাঁই সাঁই করে না হলেও, শম্বুক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। সেই গাড়িরও রয়েছে নানান পদ। বাস, বাসেরও রয়েছে রকমফের। মিনি, বড় এবং দ্বিতল, আর্টিকুলেট, দূরপাল্লার ভারি বাস। রয়েছে ছোট কাভার্ড ভ্যান, ছোট ট্রাক। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, সাইকেল, রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়িও আছে। এটি ঢাকা শহরের প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান সড়কের দৃশ্য। প্রধান সড়ক ছাড়িয়ে গলিপথে ঢুকলেও একই দৃশ্য। প্রতিটি রাস্তায় পসরা সাজিয়ে বসেছে মানুষ। ঘরে দরকার- এমন কোনো জিনিস নেই যা পাওয়া যাবে না রাস্তায়। এ আসলে গ্রামের যেকোনো হাটেরই চেনা দৃশ্য।

একসময় খুব মনে হতো শহর কি ছড়িয়ে পড়ছে? গ্রাস করছে আমার প্রিয় গ্রামকে? হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম, ফেলে আসা দৃশ্য? মাঝে মাঝে মনে ভর করা এই প্রশ্ন মন খারাপ করিয়ে দেয়। যেভাবে শহরের সীমানা বিস্তৃত হচ্ছে, ইটের পর ইটে গড়ে উঠছে ইমারত— তাতে করে গ্রামের জীবনের ফেলে আসা দিন-দৃশ্য বুঝি হারিয়েই যাচ্ছে। জীবনের তাগিদে যখন শহরে এসেছি, অস্থায়ী ঠিকানা গড়েছি, তখন থেকেই ফেলে আসা গ্রামের জন্য মন কেঁদেছে। অস্থির হয়েছি পেছনের দিনগুলোর জন্য। কিন্তু যখন এই অস্থায়িত্বের মাঝেই টিকে থাকার সংগ্রামে নিজেকে শক্ত করেছি, তখন মনে হচ্ছে, না আমরা তো কিছুই ফেলে আসিনি। আমাদের গ্রাম, চিরচেনা গ্রাম— তার নিজস্বতা নিয়েই আমাদের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে। রূপ পাল্টেছে শুধু, ধরন পাল্টেছে ইট-কাঠে।

ইট-কাঠের ইমারত দিয়েই কি শুধু তৈরি হয় নগর? গড়ে ওঠে নাগরিকতা? এ যে সত্যি নয়, তা প্রতিদিনই দেখছি। নগর শুধু নাগরিকদের জন্য, এই ধারণাও পাল্টে যাচ্ছে। একসময় নগরে প্রবেশাধিকার সবার ছিল না। প্রয়োজন ছাড়া, অনুমতি ছাড়া, নগরের প্রবেশদ্বার সাধারণের জন্য খুলত না। সেই বাধা পেরিয়ে এখন নগরই হয়ে উঠেছে আমাদের জীবিকার প্রধান আশ্রয়, আমাদের বৃহত্তম গ্রাম। যে গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা মনের গহিনে ছিল, যে গ্রাম তাড়া করে ফিরেছে স্মৃতিকে। সেই গ্রাম আজ ছড়িয়ে পড়ছে নগরে নগরে। নগরকে গ্রাস করছে গ্রাম। প্রতিনিয়ত কর্মহীন মানুষ গ্রাম থেকে উঠে আসছে, একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায়। প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার স্বপ্নকে বুকে নিয়ে উঠে আসছে মানুষ। যে গ্রাম একসময় নগরের আহার জোগাত, আজ সে গ্রাম মানুষের আহার জোগাতে পারছে না। আজ গ্রাম মানুষকে কাজের সন্ধান দিতে পারছে না, তাই মানুষ উঠে আসছে— তৈরি করছে নতুন গ্রাম।

সময়ের থেকে পিছিয়ে থাকার কারণেই কি আমাদের নগর হারিয়ে যাচ্ছে? নাকি বয়সের ভারে চারশ’ বছরের প্রাচীন রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ছে? বয়স তার বুকে ছুরি বসিয়েছে? কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। আমাদের প্রধান শক্তি তো গ্রাম। উৎপাদন এবং বিপণনের জন্য এখনো তো গ্রাম আর গ্রামীণ জনপদই ভরসা। যে গ্রাম আর গ্রামীণ জনপদ তৈরি করেছে আমাদের মানচিত্র, তাকে তো যথাস্থানে যথামর্যাদাতেই রাখা উচিত। অথচ তা না হয়ে আজ আমাদের সব কাজের কেন্দ্রস্থল রাজধানী। আমাদের অতীত কিন্তু কখনই রাজধানীকেন্দ্রিক ছিল না। শাসন ক্ষমতা রাজধানীর হাতে থাকলেও তাতে বিকেন্দ্রীকরণ ছিল। এ অঞ্চলের ঐতিহ্যই এই। রাজধানী নামের নগরই যদি দেশের সর্বকাজের কাজী হতো, তাহলে মুঘল আমলেই বা বাদশাহরা কেন তৈরি করেছিলেন মনসবদার? নদী তো আপন গতিতে বইবে। তাকে যদি বইতে না দিই, তাহলে সে তো মৃত্যুঝুঁকিতে থাকবেই। নদীর মতো নগরসভ্যতাকেও যদি তার প্রবাহ সচল রাখতে না দিই, তাহলে টিকবে কী করে নগর? আমরা যদি ভেবে নিতে বাধ্য করি, রাজধানীর বাইরে আর কিছু নেই। কাউকে কিছু করতে হলে রাজধানীতে এসেই করতে হবে, কবিতা লিখতে রাজধানীতে আসতে হবে, সাংবাদিক হতে হলে রাজধানীতে আসতে হবে, সরকারি চাকরি শুরু করতে চাইলে রাজধানীতে আসতে হবে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চাইলে রাজধানীতে আসতে হবে, নেতা হতে চাইলে রাজধানীতে আসতে হবে, রিকশা চালিয়ে জীবন বাঁচাতে চাইলে রাজধানীতে আসতে হবে, এমনকি কলার মোচা বিক্রি করতে হলেও আসতে হবে রাজধানীতে! এ যদি আমাদের স্থির সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ইতিহাসের শিক্ষা ছাড়াই বলা যায়, যে নগরকে কেন্দ্র করে সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটবে বলে মনে করা হয়েছিল, তা ক্রমশ এখন পরিণত হচ্ছে মস্ত একটি গ্রামে।

আমাদের শক্তি রাজধানীকেন্দ্রিক নয়, কখনই তা ছিল না। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অথবা সামাজিক শক্তি হিসেবে কখনই নগর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি, নগরের পক্ষে সে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভবও নয়। আমরা যদি আমাদের মূল শক্তিকে দমিয়ে রেখে একটি মাত্র নগরকে আশ্রয় করে দাঁড়াতে চাই, তাহলে ভুলে যাওয়া হবে— ইতিহাস এবং এগিয়ে চলার মন্ত্র। যাতে করে ফেলে আসা সময়, ফেলে আসা দিন, গ্রামের সেই সপ্তাহান্তের হাটবারের দিনগুলোই ঘুরেফিরে আসবে। কিন্তু তা থেকে আমরা কাঙ্ক্ষিত গতি কখনই পাব না। যে হাট গ্রামের একটি প্রধান সড়ককে ঘিরে, কোনো গাছের তলায় বসত, আজ তা যদি নগরীর কয়েক হাজার অলিতেগলিতে ছড়িয়ে পড়ে, তা তো গতিহীনতারই অন্য নাম। হাটে মানুষ আসে উৎপাদিত পণ্য আর প্রয়োজনীয় উপাদান কেনার জন্য। হাটে কোনো বিনিয়োগ হয় না, হাটে হয় বিনিময়।

বিনিয়োগ ছড়িয়ে দিতে হলে প্রয়োজন গতি, যে গতি রয়েছে গ্রামে, গ্রামীণ জীবনে। কিন্তু সেই গতিকে আমরা বৃত্তবন্দি করে জীবিকার প্রয়োজনে আটকে রাখছি একটি নগরে। ফলে জীবনই থমকে যাচ্ছে আমাদের। কিন্তু জীবন মানে যদি গতি হয়, তাহলে সেই গতি একটি নগরের জন্য খুবই প্রয়োজন। আর গতি মানে যদি চাকা হয়, তাহলে সেই চাকা একটি দেশের রাজধানীতে যদি ঘণ্টায় অন্তত দশ কিলোমিটার স্পিডেও না ঘোরে, তাতে কি নগর সভ্যতা পাখা মেলতে পারবে?

লেখক : সাংবাদিক, কবি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads