• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভারতের ছিদ্রময় তথ্যভান্ডার

  • শশী থারুর
  • প্রকাশিত ০৯ মে ২০১৮

ভারতের হাতে কোনো জাদুর কাঠি নেই, মহামূল্যবান কোনো ধাতব সম্পদও নেই। জ্বালানি তেল তো নেই বললে চলে। নেই পর্যাপ্ত পানিসম্পদ। তবে যেটা আছে, তা হচ্ছে একশ’ ত্রিশ কোটির বেশি জনসংখ্যা— যাদের গণনা চলছে। এই বিপুল জনসংখ্যা ভারতের উন্নয়ন সম্ভাবনা ধরে রেখেছে। দিয়েছে ‘নতুন জ্বালানি সম্পদ’ : তথ্যভান্ডার। কিন্তু এই সম্পদ থেকে কে লাভবান হবেন, আর কে ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন— এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথ্য সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, তিনি ডিজিটাল শাসন প্রসারিত করার লক্ষ্যে একটি আবেদনময়ী প্রচারাভিযান পরিচালনা করে আসছেন। জনগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি ভারতকে সম্মানের আসনে বসাতে চান। বায়োমেট্রিক যন্ত্রগুলো এখন স্কুলে এবং কর্মক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের এবং শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ট্র্যাক করতে ব্যবহূত হয়। ২০১৬ সালে মুদ্রারোহিতকরণ মহাযজ্ঞের মাধ্যমে মোদি ভারতের জনগণকে ডিজিটাল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। লেনদেনের ক্ষেত্রে আর নগদ অর্থ নয়— এমনকি ছোট লেনদেন ব্যবস্থাও তিনি ডিজিটালাইজড করতে বলেছেন।

আরো উচ্চাভিলাষী হয়ে মোদি-সরকার ভারতের সব বাসিন্দাকে ‘স্বতন্ত্র শনাক্তকরণ নম্বর’ বা ‘আধার কার্ড’ দেওয়ার লক্ষ্যে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতির সংযোগ ঘটিয়েছেন। ২০০৯ সালে যখন এই প্রকল্পের বীজ বপন করা হয়েছিল, তখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। প্রাথমিক অবস্থায় এর উদ্দেশ্য ছিল সরকারের পরিচালন কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করা। মূলত সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি তথা ‘সরিষার ভেতরের ভূত’ তাড়াতে আধার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। অথচ আধার প্রকল্প যখন চালু করা হয়েছিল, মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং তিনি এই প্রকল্পের ঘোর বিরোধিতা করেন। শুধু তা-ই নয়, তার ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় এলে প্রকল্পটি ভেস্তে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। বাস্তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি আধার প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ব্যক্তি চিহ্নিত নম্বরটি বস্তুত সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ‘আধার’ বা ব্যক্তি শনাক্তকরণ নম্বর সব ক্ষেত্রে ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়— দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এমন আদেশই দিয়েছেন। এই আদেশ পালনে মোদি সরকার নিশ্চয়তা দিলেও ব্যাংক হিসাব খুলতে, স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি, মোবাইলের সিম নিবন্ধনে, ভ্রমণ রেকর্ড, হাসপাতালে ভর্তি, এমনকি মৃত্যুর পরে সৎকারের ক্ষেত্রেও আধার চাওয়া হচ্ছে।

যা হোক, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মোদি বদ্ধপরিকর। তিনি দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, তথ্যই ‘প্রকৃত সম্পদ’ এবং যারা সেটা অর্জন করে, তারাই কেবল আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। নরেন্দ্র মোদি গত চার বছর কেবল ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং মজবুত করতে ব্যস্ত ছিলেন। এতদিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও উচ্চকক্ষে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ইতোমধ্যে ২৯টি রাজ্যের ২২টিরই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। ফলে বিজেপি এখন উভয় কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

ভারত সম্পর্কে মোদির দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- বৃহৎ সরকারের জন্য অনেক বড় ‘তথ্যভান্ডার’ থাকা চাই। কেননা তথ্যের প্রাচুর্য সমস্যা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাস্তবে গ্রামাঞ্চলে প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট সংযোগ অথবা বিদ্যুতের অভাবে আধার হোল্ডারদের শনাক্ত করার কার্যক্রম ব্যর্থ হতে পারে। ফল স্বরূপ, আধার প্রকল্প থেকে অনেক দরিদ্র জনগণ বাইরে থেকে যাবে। অর্থাৎ তারা সরকারি নানা সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হবে। আর এটা তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যথষ্ট।

এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত হলে আধার প্রকল্প চালুনির মতো ফুটো হয়ে পড়বে। দ্য ট্রিবিউন পত্রিকার একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক মাত্র ৫০০ রুপির বিনিময়ে ৫০ হাজার আইডি নম্বর ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছেন। কম্পিউটার প্রযুক্তিতে প্রাথমিক দক্ষতা থাকলে সরকারি একটি তেল ও গ্যাস কোম্পানির ওয়েবসাইটে যে কেউ ৫০ কোটি ভারতীয় নাগরিকের নামধাম, ব্যাংক হিসাব ও আধার নম্বর উন্মুক্ত করতে পারেন। পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ভুলবশত প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ আধার নম্বর প্রকাশ করা হয়েছিল। আরো একটি ঘটনায় অন্ধ্র প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি জনগণের আধার নম্বর ফাঁস হয়। সর্বোপরি আধার প্রকল্প একটু বেশিই আপস করছে— ৮ কোটি ৭০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য কথিত ভুলে মার্কিন রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গে শেয়ার করা হলেও মোদি সরকার কেবল অস্বীকৃতি ও গোপনীয়তা রক্ষার প্রস্তাব করেছে।

তথ্য সংরক্ষণের ব্যর্থতা মোদিকে যেন পেয়ে বসেছে। ২০১৫ সালে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে খুদে বার্তা ও ইমেইল গ্রহণের জন্য তার অনুসারীদের আহ্বান জানানো হয়। আর সেটা পেতে গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে ‘নরেন্দ্র মোদি মোবাইল অ্যাপ’ ডাউনলোড করা আবশ্যক ছিল। মোদি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই অ্যাপে ‘থাকবে না কোনো মধ্যস্বত্বভোগী, থাকবে না কোনো মধ্য-মাধ্যম, কোনো কর্মচারী লাল ফিতায় সেটা আটকে রাখতে পারবে না।’ তখন প্রায় ৫০ লাখের বেশি সেই অ্যাপটি ডাউনলোড করা হয়।

কিন্তু অঘটন একটা ঘটেছিল। সেই অ্যাপ মোদির অনুসারীদের ছবি, ফোন নম্বর লিস্ট, জিপিএস ডাটা, মাইক্রোফোন ও ক্যামেরায় প্রবেশানুমতি পেয়েছিল। দুঃখজনকভাবে সেই তথ্যগুলোও আমেরিকান একটি ফার্মের কাছে ভাগাভাগি করা হয়। অ্যাপ ব্যবহারকারীরা জানত না যে, এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে তাদের সম্মতিও ছিল না। অ্যাপটির গোপনীয়তা কৌশলে পরিবর্তন আনার বিষয়টি সত্য। তবে মার্কিন সংস্থাটি তার আগেই সব তথ্য থলিতে ভরে নেয়। ভারতীয় জনগণের এসব তথ্য কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, অথবা ভবিষ্যতে কী করা হবে সেটা কে জানে?

তথ্য সংগ্রহ ও সুরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলোর পরিসর আগামী দিনে আরো বাড়তে থাকবে। ধারণা করা হয়, গত দুবছরে বিশ্বের ৯০ শতাংশ তথ্যের উৎপত্তি সাধন করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে তথ্য শেয়ারের হার ভারতেই বেশি। অপ্রতিরোধ্য ফোর-জি সেবা, স্বল্পমূল্যের ইন্টারনেট ও অসংখ্য মানুষের হাতে স্মার্টফোন ব্যক্তিগত তথ্য পুঞ্জীভূতের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সন্দেহ নেই ভারত বিশ্বের বৃহৎ তথ্যভূমি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে— ভারত তথ্য ফাঁসের স্বর্গভূমি হবে না তো? এখন পর্যন্ত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা ও আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। এ লক্ষ্যে আমার নিজস্ব উদ্যোগে আনা একটি বেসরকারি বিল পার্লামেন্ট অচলাবস্থার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তথ্য সম্পদের প্রতি মোদির মোহ রয়েছে। যারা তথ্যসম্পদ উৎপাদন করছেন— ওইসব জনগণকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মোদি সরকারের উচিৎ হবে ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক সেবা’ নিশ্চিত করা। 

লেখক : লোকসভার কংগ্রেস দলীয় সদস্য এবং মানব সম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী

অনুবাদ : মো. রাশিদুল ইসলাম

স্বত্ব : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads