• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

প্রতীকি

মতামত

অস্বাভাবিক মৃত্যু চাই না

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১০ মে ২০১৮

শিরোনাম দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন, এ নিবন্ধের লেখক প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেনের কালজয়ী কলাম— ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’-এর অনুকরণে করা। ভাবনাটি অমূলক নয়। কেননা যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তিনি ওই শিরোনামে কলামটি লিখেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে কতটা ভালো এ নিয়ে কম-বেশি আলোচনা হতে পারে হয়তো।

গত ৩ মে পার্বত্য রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা নিজ কার্যালয়ের সামনে খুন হয়েছেন দুর্বৃত্তদের গুলিতে। তিনি জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা গ্রুপ) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সংগঠনটি ইউপিডিএফ নামের আরেকটি সশস্ত্র সংগঠনকে দায়ী করেছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, অফিসে প্রবেশের মুখে ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাস্থল থেকে নানিয়ারচর থানার দূরত্ব মাত্র এক শ গজ। থানার এত কাছে দুর্বৃত্তরা একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস কী করে পেল, এটা ভেবে চিন্তিত সবাই। পত্রিকার খবরেই বলা হয়েছে, থানার এত সন্নিকটে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ড নানিয়ারচর উপজেলাবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে জননিরাপত্তা নিয়ে।

একই দিনে আরেকটি রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ওইদিন বেলা ২টার দিকে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় যোগদান শেষে মোটরসাইকেলে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসা হয়নি তার। পথিমধ্যে আলীনগর নামক স্থানে তাকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত সিরাজুল হক বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, পূর্বশত্রুতার কারণেই তিনি নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

একই দিনে প্রকাশ্য দিবালোকে দুজন জনপ্রতিনিধির এভাবে খুন হওয়ার ঘটনা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। যদিও ঘটনা দুটি দেশের দুই প্রান্তের এবং একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে যুগপৎ এ জোড়া খুন একটি বিষয়কে আবারো সামনে নিয়ে এসেছে, সে সঙ্গে তুলে ধরেছে কিছু প্রশ্ন। উল্লিখিত দুটি খুনের ঘটনার একটি জায়গায় মিল রয়েছে। তা হলো দুটি হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে দিনে-দুপুরে। অর্থাৎ আমদের দেশে এখন দিনেও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। যে কেউ যেকোনো সময় আততায়ীর হাতে জীবন হারাতে পারে।

এদিকে গত ৪ মে রাঙামাটির নানিয়ারচরেই ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন পাঁচজন। এরা আগের দিন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। খবরে বলা হয়েছে, নানিয়ারচরের সাবেক্ষং ইউনিয়নের তেছড়ি এলাকায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে এই পাঁচজন নিহত হন। উপর্যুপরি দুই দিনে অর্ধডজন খুনের ঘটনা পার্বত্য এলাকা আবারো অশান্ত হয়ে ওঠার আলামত বলে মনে করছেন সচেতন মহল। শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পরেও যে পার্বত্য এলাকায় শান্তি ফিরে আসেনি এ ঘটনা তারই প্রমাণ।

এরই মধ্যে আমাদের জানতে হলো আরেকটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। গত ৭ মে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমূল ইউনিয়নের ডাবুইর এলাকার এক ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে হাত-পা বাঁধা গলাকাটা চারটি লাশ। নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। খবরে বলা হয়েছে, এরা নিম্নআয়ের কর্মজীবী মানুষ। তবে এদের মধ্যে এক-দুজন মাদক ও জুয়া ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, অবৈধ ব্যবসায়ের লেনদেন বা দেনা-পাওনা সংক্রান্ত বিরোধের কারণে এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ বলেছে, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

এমন খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। রাস্তার পাশে, নদীর ধারে কিংবা ঝোপ-জঙ্গলে অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কারো পরিচয় পাওয়া যায়, কারোটা পাওয়া যায় না। যাদের পরিচয় পাওয়া যায়, তাদেরকে স্বজনরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকার করার সুযোগ পায়। কিন্তু যাদের পরিচয় পাওয়া যায় না, তাদের সৎকার হয় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। সৃষ্টির সেরা জীব একজন মানুষের জন্য এটা যে কত দুর্ভাগ্যজনক, সেটা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।

দুর্ভাগ্য আসলে এ জাতির। আমরা শান্তির সন্ধানে এখানে সেখানে প্রতি মুহূর্তে দৌড়ঝাঁপ করি। কিন্তু সে সোনার হরিণ ধরা দিচ্ছে না। রাজনীতিকরা আমাদের শান্তির বাণী শোনান, আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে অপেক্ষার কথা বলেন। একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বাংলাদেশের কথা তারা বলেন। ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে দেশবাসীর কোনো চিন্তা থাকবে না, ভয় থাকবে না, সন্ত্রাস যাবে কর্পূরের মতো উবে, জনজীবন হবে নিঃশঙ্ক’ ইত্যাদি সব আশাজাগানিয়া বাণী আমরা প্রায়ই শুনি। শুনি আর আশায় বুক বাঁধি। এই বুঝি শান্তি-সুখের পায়রা উড়ে এসে বসবে আমাদের ঘরের চালায়। কিন্তু সে শ্বেতকপোত আর আসে না।

পৃথিবীতে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের হাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। আমাদের দেশেও এ ঘটনা বহুকাল আগে থেকেই ঘটে আসছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে দুর্বৃত্তদের দমন করে জনজীবনে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের যে উদ্যোগ সরকারকে নিতে দেখা যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে তা পুরো নির্ভর করার মতো দেখা যায় না।

গণমাধ্যমে এ ধরনের অপহরণ, গুম আর খুনের খবর হরহামেশাই উঠে আসছে। এই তো ক’দিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সংগঠনের উদ্যোগে খুন-গুমের ওপর গণশুনানি হয়ে গেল। সেখানে এসেছিলেন স্বজনহারা মানুষেরা। বলেছেন তাদের বেদনার কথা। তাদের বক্তব্যে স্বজন হারানোর বেদনার পাশাপাশি সরকারের প্রতি ক্ষোভের কথাও ছিল। উপস্থিত প্রায় সবাই গুম-খুনের জন্য সরকারি বাহিনীর দিকেই তাদের অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তাদের এ অভিযোগকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ ‘সাদা পোশাকের বিশেষ বাহিনী’র নামে যাদের ধরে নেওয়া হয়, তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেন না। যারা ফিরে আসেন, তারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মুখ খোলেন না। ফলে এসব অপহরণ গুম সম্পর্কে মানুষের মনে সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রশ্নের। তবে সেসব প্রশ্নের কোনো জবাব কেউ দিচ্ছে না।

মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই এটা চিরন্তন সত্য। যে কেউ যে কোনো সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। তাছাড়া মানুষের জীবনে অনেক বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে— ‘কুলু্ল নাফসিন জাইকাতুল মউত’ অর্থাৎ সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সবকিছু থেকে রেহাই পাওয়া গেলেও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই মেলার কোনো সুযোগ নেই। কবি বলেছেন— জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে। কবিগুরু তার কবিতায় বেঁচে থাকার আকুলতা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। তিনি অবশ্যই মানবের মাঝে এখনো বেঁচে আছেন। তবে তা তার কালজয়ী সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু বিশ্বস্রষ্টার অমোঘ নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি বাঁচতে পারেননি। তাকেও মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।

মানুষ মরণশীল— এটা চিরন্তন সত্যের অন্যতম একটি। তবে সেই মৃত্যু যদি স্বাভাবিকভাবে অর্থাৎ রোগব্যাধিতে ভুগে পরিণত বয়সে হয়, তাহলে এই পরিণতি কষ্ট ও বেদনাদায়ক হলেও মেনে নেওয়া যায়। স্বজনরা ব্যথিত হন, কান্নার রোল ওঠে, ভারাক্রান্ত হয় প্রতিবেশীদের হূদয়। তারপর স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে সবাই মেনে নেন। কিন্তু একজন তরতাজা মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে যখন লাশ হয়ে ফেরেন, তা কি মেনে নেওয়ার মতো? স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণের এই যে অনিশ্চয়তা এটা কি কোনো সুস্থ সমাজের নিদর্শন? কেউ কেউ বলতে পারেন, সমাজ থেকে অপরাধ একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। মানবারণ্যে কিছু দ্বিপদ হিংস্র প্রাণী তো জন্ম নিতেই পারে। হ্যাঁ, তা পারে। গাছ থাকলে আগাছাও জন্মাবে এটা ঠিক। তবে সে আগাছা যদি পুরো বাগানকে গ্রাস করে ফেলে, সমস্যাটা হয় তখনই আর সে জন্যই আগাছা নির্মূলের ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু সে ব্যবস্থা কি সঠিকভাব নেওয়া হচ্ছে?

এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দায়িত্বশীলরা অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন হয়তো। কেননা তারা এটা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না, সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা দুর্বৃত্ত নামের সেসব আগাছা নির্মূলে তারা কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। বরং সমাজের ওপরতলা থেকে ওইসব আগাছাকে তরতর করে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়ার নজিরের অভাব নেই। একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা মাদক ব্যবসায়ীকে যখন অত্যন্ত প্রভাবশালীর পাশে বসে থাকতে বা চলাফেরা করতে দেখা যায়, তখন বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় কেন সমাজটা শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যের মতো হয়ে গেছে, কেন মানুষ শান্তিতে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারছে না, কেন মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিন দিন কমে আসছে।

সমাজ নিয়ে কম-বেশি সবাই ভাবেন। ভাবতে বাধ্য হন। প্রত্যেকে নিজের জন্যই ভাবেন। প্রতিটি নাগরিক আজ উৎকণ্ঠিত, শঙ্কিত। আমাদের এই সুন্দর দেশটি ক্রমেই যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। নির্ভয়ে কেউ আর চলতে বলতে পারেন না। সদা ভয়, সদা আতঙ্ক। জীবনের অনিশ্চয়তা প্রতিটি মানুষকে বিচলিত করে তুলেছে। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল যে তরুণী মেয়েটি, সন্ধ্যায় ইজ্জত-সম্ভ্রম নিয়ে অক্ষত দেহে ফিরে আসতে পারবে কি-না, এ শঙ্কায় ভোগেন প্রতিটি বাবা-মা। স্বীকার করতে লজ্জা থাকার কথা নয়, আমরা এ সমাজকে মানুষের অভয়ারণ্য বানাতে পারিনি। বরং আমাদেরই কারণে তা দিন দিন হয়ে উঠছে দুর্বৃত্ত-অপরাধীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। আর মানুষের জীবন হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। সে সঙ্গে সংকুচিত হয়ে আসছে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার।

 

 লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads