• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

রূপ ও রহস্যের নগরী প্যারিস

  • মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১১ মে ২০১৮

বর্তমান বিশ্বে কেউ একটি দেশ দেখতে চাইলে তাকে যেতে হবে মিসর। আর কেউ একটি শহর দেখতে চাইলে যেতে হবে ইউরোপের প্যারিস। এটা আমার কথা নয়- জ্ঞানী ও গুণীজনের অভিজ্ঞতার কথা। বিশ্বের সৌন্দর্য ও আধুনিক নগরীর অন্যতম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। যার তুলনা করা যায় না।

সম্প্রতি ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে একটি এনজিও বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। এবার প্যারিস থেকে দ্রুততম ট্রেন টিজিবি ডুপ্লেক্সে (যা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩১৯ কিলোমিটার বেগে ছুটে থাকে) করে সুইজারল্যাল্ডের জেনেভা শহর ও বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস সফর করে অনেক কিছু জানা ও শেখার অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করেছি। টিজিবি ট্রেনে এই আমার প্রথম ভ্রমণ। দ্রুতগামী এ ট্রেন সংযুক্ত করেছে ফ্রান্সের প্রধান শহরগুলো ছাড়াও ইউরোপের অনেক দেশের রাজধানীকে। ফ্রান্সের এসএনসিএফ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে এ ট্রেন ২০১১ সাল থেকে ইউরোপের বিভিন্ন রুটে চলাচল শুরু করে।           

প্যারিস নগরী সত্যিই অপূর্ব ও চমৎকার। এর কোনো জুড়ি নেই বা অন্য কোনো দেশের নগরীর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শিল্পীর অঙ্কনে উদ্ভাসিত এবং পর্যাপ্ত আলোয় আলোকিত ব্যস্ত নগরী প্যারিসে স্বল্প সময়ের জন্য আসা বা বেড়ানো কোনোটাই পূর্ণতা বয়ে আনবে না। প্যারিস নগরীতে ঘুরে বেড়ানোর বহু স্থান রয়েছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না। প্যারিসে কেউ এলে আইফেল টাওয়ার, প্যারিস গেট, বাস্তিল দুর্গ, প্যারিসের সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গ্যালারি লাফায়েত, মোলা রুজ নাইট ক্লাব, ডায়না সাট (সেন নদীর ট্যানেলে যেখানটায় লেডি ডায়না গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান), আর্চ অব ট্রয়াঞ্চ গ্যালারি লাফায়েত, প্রেসিডেন্টের বাসভবন এলিজি প্যালেস, এনভারস্ এ মোমার্থ, পার্লামেন্ট হাউস, লুভ জাদুঘর, নটর ডেম গির্জা, কনকর্ড টাওয়ার, গিমে জাদুগর, নেপোলিয়নস টুম ইত্যাদি না দেখলে জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।

আইফেল টাওয়ারে না উঠে সম্পূর্ণ প্যারিস শহরটাকে অতি সহজে দেখা সম্ভব নয়। তাই আইফেল টাওয়ারে ওঠা চাই। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার মধ্য যুগে সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে ছিল একটি। এখনো প্যারিসের প্রধান শোভা আইফেল টাওয়ার। ১৮৮৯ সালে মি. গুসটাভ আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করেন। পুরো টাওয়ারটা তৈরি করতে লোহা বা স্টিলের মোট মেটাল পার্টস বা যন্ত্রাংশ ছিল ১৮ হাজার ৩৮টি। আইফেল টাওয়ারটি চারটি বিশাল লোহার পিলারের ওপর দাঁড়ানো। প্রায় ২৫০ জন নির্মাণকর্মী বা শ্রমিক ২ বছর ৫ মাস ধরে বিরামহীনভাবে নির্মাণকাজ শেষ করতে পেরেছিলেন। রাতে আইফেল টাওয়ারে কয়েক লাখ রঙিন বাতি বার বার তার রঙ বদলাচ্ছে। পুরো টাওয়ারের গায় লাখ লাখ বাতি জ্বলছে। এ দৃশ্য রাতের বেলায় দেখতে কী যে অপূর্ব লাগে তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো কঠিন। দূর থেকে আইফেল টাওয়ার দেখতে খুব সরু মনে হলেও আসলে কিন্তু তা অনেক প্রশস্ত ও বিশাল। একই সঙ্গে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার দর্শনার্থী আইফেল টাওয়ারে উঠতে পারে। আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা ১০৮১ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং এর ওজন ১০ হাজার ১০০ টন। ভ্রমণ বা দেখার জন্য সিঁড়ি বা লিফটের সাহায্যে টাওয়ারটির শীর্ষস্থানে ওঠা যায়। সেখান থেকে প্যারিস নগরীর সৌন্দর্য চমৎকারভাবে উপভোগ করা এবং প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত শহরটি দেখা যায়। প্যারিসের প্রধান শোভা এখনো আইফেল টাওয়ার। অবশ্য শুধু ফ্রান্স কেন সারা দুনিয়ার মানুষের কাছেই ওটার একটা আলাদা মর্যাদা আছে। আইফেল টাওয়ার এলাকাটি সুন্দর ও চমৎকার। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যস্ত নগরীর মধ্যে প্যারিস অন্যতম হলেও মাটির নিচে মেট্রো থাকার কারণে রাস্তায় তেমন যানজট না থাকলেও গাড়ি পার্কিংয়ে সঙ্কটের কারণে গাড়ির মালিকদের পুলিশের ভয়ে তটস্থ থাকতে দেখা যায়। তবে প্যারিস শহরের পুলিশের ব্যবহার ও ভদ্রতা দেশি-বিদেশি সবার কাছে প্রশংসিত।

রাজধানী প্যারিসের রাস্তায় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বার, নাইট ক্লাব ইত্যাদি ভরপুর। নগরীর লোকজন ঘর থেকে বাইরে বা রেস্টুরেন্টে খেতে বেশি পছন্দ করে। বন্ধের দিন শনি ও রোববার বাসায় বেশ ধুমধাম পার্টির আয়োজন করে। প্যারিসে সকালের জনপ্রিয় নাশতা হচ্ছে বাগেট এবং চিজ। বাগেট হচ্ছে এক ধরনের লম্বা শক্ত রুটি। এখানকার মানুষ প্রচুর চিজ খায়। প্যারিসে রয়েছে প্রায় দু’ থেকে তিনশ’ প্রকারের চিজ। প্যারিস শহরকে বলতে হবে কফি শপ, ফুড শপ আর সেফস শপের শহর। শহরজুড়ে অসংখ্য খাবারের দোকান। তবে ফরাসিরা কাঁচা খাবার খুব পছন্দ করে। মাছ বা মাংস থেকে রক্ত ঝরছে এমন খাবার তাদের ফার্স্ট চয়েস।

ফ্রান্সে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি-ছিনতাইয়ের তেমন কোনো ভয় নেই। ঐতিহাসিক সিন নদীর ওপর দিয়ে প্যারিস নগরীর চতুর্দিকে টুরিস্ট বোট দিয়ে ভ্রমণ করা যে কত মনোমুগ্ধকর তা সত্যিই অকল্পনীয়। প্রায় ৭ কোটির জনসংখ্যা অধ্যুষিত ফ্রান্সের রাজধানীতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের বসবাস। প্যারিস শহর কম টাকায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য আরিয়ার (ট্রেন) মেট্রোর সুব্যবস্থা রয়েছে। শৃঙ্খলা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সহজে কেউ আইন ভঙ্গ করে না। দেশটিতে মরক্কো, আলজেরিয়ান, আফ্রিকান, লোক অনেক। এখন ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি লোকের সংখ্যাও একেবারে নগণ্য নয়। প্যারিসের গারদু নর্ড এলাকাটি বাংলাদেশিদের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভরা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এখানে জমে ওঠে বাঙালিদের মিলনমেলা। ফ্রান্সে ২০-৩০ হাজার বাঙালি বসবাস করেন। কেউ কেউ ফরাসি মেয়ে বিয়ে করে সংসারও গড়েছেন। তারা মোটামুটি ভালোই আছেন।

ফরাসিরা জাতি হিসেবে খুবই ভদ্র এবং অমায়িক। তারা ফুল ভালোবাসে বলে আপনজনের বিয়ে, জন্ম ও মৃত্যুতে ফুল উপহার দিয়ে সম্মান জ্ঞাপন করে থাকে। প্যারিসে প্রতিদিন প্রচুর ফুল বেচাকেনা হয়ে থাকে। যদিও প্যারিসে যে কোনো জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। তার পরও ফ্রান্সের পারফিউম বিশ্ববিখ্যাত। কোনো সময় প্যারিস সফরে এসে আইফেল টাওয়ার দেখতে এবং সেখানকার খ্যাতনামা পারফিউম ক্রয় করতে ভুল করবেন না।

লেখক : ইউনেস্কো ক্লাবের মহাসচিব

unescoclubbd@yahoo.com 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads