• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

বৈরী প্রকৃতি

জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১২ মে ২০১৮

বদলে যাচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে গোটা দুনিয়া উষ্ণ হয়ে উঠছে। ফলে অসময়ে বন্যা, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রায় প্রতিবছরই কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে জীবনহানি, ফসলহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বণ নিঃসরণের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন এসেছে। সে পরিবর্তনের জন্য সমূহ ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শত-সহস্র কোটি মানুষকে। যারা প্রয়োজনের তাগিদে ফসলের জমিতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে কিংবা জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে যেতে বাধ্য হয়, তারাই বজ্রপাতের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। আর মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ডা. টমাস ডব্লিউ স্মিথলিন তার ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোস্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে কত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে তা প্রকাশ করে দুর্যোগ ফোরাম। দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বজ্রপাতে ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় মে মাসে ৯১ জনের। আর ২০১৬ সালের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৬১ জন। স্মরণযোগ্য যে, ২০১৬ সালের মে মাসে মাত্র দুই দিনে মারা যান ৮১ জন। ওই সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া ওই সময় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। কয়েক বছর ধরে আগাম বৃষ্টিপাতের কারণে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শুধু যে বাংলাদেশেই আগাম বৃষ্টি হচ্ছে, তা নয়;  প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আগাম বৃষ্টি ও আগাম বন্যার কারণে উজানের পানির ঢলে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়। ফলে আধাপাকা ধানও অনেক সময় চাষিরা স্বাভাবিক নিয়মে ঘরে তুলতে পারেন না। গত বছর হাওর অঞ্চলের পুরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে দেশে ধান-চালের দর বেড়ে যায়। সাধারণ ভোক্তারা কষ্টে পড়েন। সে অবস্থা থেকে এ বছরের হাওরের চিত্র ভিন্ন। এ বছর হাওরের চাষিরা ইতোমধ্যেই প্রায় পুরো পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছেন। এ তো গেল হাওর অঞ্চলের অবস্থা। এর বাইরেও গত ক’দিনের ভারি বর্ষণে উত্তরাঞ্চলের চলনবিলসহ নিম্নাঞ্চলের পাকা ধান তলিয়ে যাওয়ার খবর প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। চাষিরা পানিতে আধা ডোবা ধান কেটে নৌকা কিংবা ভেলায় করে শুকনো জায়গায় নিয়ে যান। এর ওপর আবার মাত্রাতিরিক্ত বজ্রপাতের ভয়ে কৃষিশ্রমিকরা সহসাই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ধান কাটতে সাহস পান না। ফলে কামলাও পাওয়া যায় না। চাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনিতেই বর্তমানে কৃষিশ্রমিকের বড়ই সঙ্কট। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় অনেক জায়গায় কৃষিশ্রমিকের অভাবে ধান কাটা বিলম্বিত হয়। তার ওপর যদি বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে, তাহলে সঙ্কটের মাত্রা কতটা বেড়ে যায়- তা সহজেই অনুমেয়। সম্প্রতি ভারতের দুটি রাজ্যে ধুলা ঝড়ে প্রায় ১৪০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সঙ্কট এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মহামারীতে রূপ নিয়েছে। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, দেশে উঁচু গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। উঁচু গাছ থাকলে ওই গাছেই বজ্রপাত হতো, গাছই বজ্রবিদ্যুৎ টেনে নিত। উঁচু গাছ না থাকায় খোলা মাঠে, হাওরে বা নদীতে বজ্রপাতের কারণে মানুষের মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। শহরেও বজ্রপাত হয়। কিন্তু সেখানে উঁচু ভবন, স্থাপনা বা বিদ্যুতের উঁচু খুঁটি থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা তেমন ঘটে না। গ্রামের পর গ্রামে উঁচু গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, অর্থাৎ প্রকৃতির ওপর আমরা অবিচার করায় প্রকৃতিও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। ফলে বজ্রপাতের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। অবশ্য বাস্তব এ অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকার বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকারি উদ্যোগে ১০ লাখ তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। থাইল্যান্ডে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতের মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হয়েছে। ভিয়েতনামে উঁচু টাওয়ার নির্মাণ করে বজ্রপাতের বিপদ কমানো হয়েছে। বাংলাদেশেও হাওর এলাকায় তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (বিএমডিএ) ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গায় ৩০ লক্ষাধিক তালগাছ লাগিয়েছে। এ উদ্যোগকে আরো সম্প্রসারিত করতে দেশের বিভিন্ন এনজিও কিংবা সামাজিক সংগঠনের তরফে তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে গোটা দেশেই তালগাছ লাগানো সম্ভবপর হবে। তালগাছ লাগানো কঠিন এবং ব্যয়বহুল কোনো কাজ নয়। কেবল অন্যকে পরামর্শ না দিয়ে প্রত্যেকেই যদি বাড়ির আশপাশে কিংবা জমির আইলে পুকুর, খাল, ডোবার পাশে স্ব-উদ্যোগে তালগাছের চারা লাগায়, তাহলে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ সহসাই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। দেশের মানুষ সচেতন হলে প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর খেলাকে রোধ করা কঠিন হবে না।

প্রায় প্রতিবছরই কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের জীবন, ফসলহানির ঘটনা ঘটছে। এমতাবস্থায় মানুষের বাসোপযোগী পরিবেশ রক্ষার জন্য সবুজ প্রকৃতি গড়ে তোলা এবং তা রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। তালগাছ সারিবদ্ধভাবে লাগালে যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে, তেমনি এই গাছ মানুষের অনেক উপকারেও আসবে। তালগাছের রস দিয়ে তালমিছরি তৈরি হয়, যা অনেক রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। আবার কাঁচাপাকা দু’ভাবেই তাল খাওয়া যায়। সবদিক বিবেচনায় তালগাছের চারা রোপণ করে একটু পরিচর্যা করতে পারলে হয়ত ভবিষ্যতে বজ্রপাতের নিষ্ঠুর খেলায় প্রাণহানির শঙ্কা অনেকাংশেই কমে আসবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads