• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

সামাজিক অবক্ষয় রোধে চাই আত্মোন্নয়ন  

  • জি কে সাদিক
  • প্রকাশিত ১৩ মে ২০১৮

অন্য প্রাণী থেকে মানুষ শ্রেষ্ঠ তার চারিত্রিক গুণ বিচারে ও ভাবনাগত স্বাতন্ত্র্যের জন্য। কাজ সব প্রাণীই করে তবে মানুষের কাজের স্বাতন্ত্র্য এই যে, মানুষ কাজ করার আগে ভেবে কাজ করে। মানুষ কত বড়? সহজ উত্তর- তার ভাবনার সমান। তাই মানুষের ভাবনা যত বড়, মানুষও তত বড়। মনে রাখা দরকার- আমরা যেমন ভাবব, যেমন কর্ম করব তেমন কর্মফল পাব। সুতরাং, ভাবনার জগৎটা যদি প্রশস্ত না হয়, কর্মও বড় হবে না। সে জন্য আমাদের এগিয়ে চলার গতি যেমন অতি শ্লথ হবে, ভবিষ্যৎটাও তেমনি সঙ্কুচিত হবে। ব্যক্তি নিজে যেমন চরিত্র গঠন করবে, সে আলোকে তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠিত হবে।

আমরা প্রত্যেকেই সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশ। আমাদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের সমাহার আমাদের সমাজ। যদি আমাদের ব্যক্তি ও কর্মজীবন রোগগ্রস্ত, নষ্ট, জরাজীর্ণ ও দুর্গন্ধময় হয়, তাহলে আমাদের সমাজটাও হবে রোগগ্রস্ত, নষ্ট, জরাজীর্ণ ও দুর্গন্ধময়। আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের নাগালের সমাজংশটুকু স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল ও বাসযোগ্য রাখি- তাহলে আমাদের এ সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে গোটা সমাজদেহটাই স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল ও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ কিছু জায়গায় দায়বদ্ধ। সেটা নিজের, সমাজের ও দেশের কাছে। আমি যদি আমার ব্যক্তিজীবনের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি তাহলে আমার ব্যক্তিজীবন সফল ও সুন্দর হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই কথা। অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের স্বাতন্ত্র্য এই যে, আমাদের একটা বিবেক আছে। যে বিবেক অনুধাবনে আলোড়িত হয়। সে আলোড়ন যার যত গভীর তার ভাবনা ও কর্ম তত গভীর। যার বিবেকবোধ যত ইতিবাচক সে কর্মেও ততটাই ইতিবাচক। অন্য প্রাণী থেকে মানুষ ভাবনা, কর্ম ও চরিত্র আদর্শের বিচারে উৎকৃষ্ট।

আবার মানুষের মধ্যে এই তিনটি বিষয়ে ইতিবাচক চর্চায় পার্থক্যের কারণে ব্যক্তিবিশেষে আলাদা সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করে। ভাবনা যদি ইতিবাচক হয় তাহলে কর্ম ইতিবাচক হবে। আর ইতিবাচক ভাবনা ও কর্মের সমন্বয়ে উৎকৃষ্ট চরিত্র গঠিত হবে। তবেই অন্য প্রাণিকুল থেকে মনুষ্য চরিত্র বিশেষ সম্মান ও উচ্চতার দাবি করতে পারে। যদি তা না হয় তাহলে কেবল দৈহিক আবরণে মানুষ হলেও আমাদের আচরণ হবে হিংস্র, বন্য ও বর্বরতায় পূর্ণ। তাই আমাদের ভাবনার জগৎকে ইতিবাচক করতে হবে তাহলে ভাবনাও হবে গভীর ও ভারপূর্ণ। ভাবনার জগৎকে প্রসারিত করতে হলে অবশ্যই সবার আগে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লালসা থেকে মুক্ত হতে হবে। নয়তো আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাব। তখন আমাদের বিবেকে যে ভাবনার উদয় হবে তা কেবলই অতিশয় ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য। যা মনুষ্য চরিত্রের গুণ নয়।

দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড দেখিয়েছেন, ব্যক্তি চরিত্র গঠিত হয় তিনটি উপাদানে- প্রবৃত্তি, অহংবোধ ও অহমিকার সমন্বয়ে। মানব চরিত্রে প্রবৃত্তি থাকবে, কিন্তু সে ব্যাপারে প্রথমেই বলেছি যে, ইতিবাচক হতে হবে। যদি প্রবৃত্তির পাশবিকতা নৈতিক গুণাবলিকে ছাপিয়ে যায়, তাহলে মনুষ্য চরিত্রের পতন অনিবার্য। সমাজবিজ্ঞানে একটা কথা আছে, অধিকাংশ মানুষ নিরাপত্তা চায়, স্বাধীনতা নয় (স্বাধীনতার চাইতে নিরাপত্তা বেশি কাম্য এটা বোঝাতে)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, হাল ধরে রাখলে নৌকা নিরাপদ, কিন্তু স্বাধীন নয়। যদি এখানে নৌকাকে স্বাধীনভাবে ছাড়া হয় তাহলে নৌকা নিরাপদ নয়। মানুষ স্বাধীন সত্তা জন্মগতভাবে। যদি নিরাপত্তা না থাকে এ স্বাধীন সত্তা বিকশিত হতে পারে না। যদিও স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা দুটি বিষয়ে বিশেষ পার্থক্য করা কঠিন। যদি আমাদের ভাবনাটা স্বাধীন হয়, আর কর্মটা নিরাপদভাবে করা যায় তাহলে বোধহয় সমন্বয় হয়। পাশ্চাত্যে রেনেসাঁসের পূর্বে সাহিত্য জগতে রোমান্টিক সাহিত্য রাজত্ব করত।

রোমান্টিকতা মানুষের মনে ভাবনার দরজা খুলতে বিরোধপূর্ণ ভূমিকায় থাকে। অতিলৌকিক ও কল্পনার চূড়ায় না উঠলে রোমান্টিকতা উপলব্ধ হয় না। আর উপলব্ধি করতে গেলে মানুষের ভাবনাসত্তা আর বাস্তবতার সঙ্গে চলতে পারে না। তখন জগৎ-সংসার থেকে দূরে উল্লাসে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। ইউরোপে যখন রোমান্টিকতার স্থান সঙ্কুচিত হয়ে মানুষের কথা কলমে প্রকাশিত হয়েছে, তখনই মানুষের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। একসময় এ পরিবর্তন প্লাবনসম হয়ে গোটা ইউরোপকে পরিবর্তন করে দিল। যে পরিবর্তনের ছটা বিশ্বের অন্য প্রান্তেও দোলা দিতে লাগল। উনিশ শতক পর্যন্ত ভারতবাসী ছিল নানা ধরনের প্রণয়োপাখ্যানের আবরণে বাঁধা। যাতে ছিল রসের প্রগাঢ়তা, কিন্তু ছিল না জীবনবোধ। যখন থেকে ভারতবাসী আপনাকে বুঝতে শিখেছিল তখন থেকেই বুঝতে পারে, তাদের পায়ে শিকল আছে যেটা ভাঙতে হবে। সেটা তারা ভেঙেছিল তাদের ভাবনায় কর্মে ও চরিত্রাদর্শের দৃঢ়তা দিয়ে। তাই সমাজ পরিবর্তনের পূর্বকথা হলো, ব্যক্তির ভাবনা কর্ম ও চরিত্রাদর্শের পরিবর্তন করা।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads