• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আমরা কেন এত নিশ্চুপ

  • আমজাদ হোসেন
  • প্রকাশিত ১৪ মে ২০১৮

জামালপুর। আগে ছিল সাবডিভিশন। এখন জেলা। আমার জন্ম এই মফস্বল টাউনেই— ব্রিটিশ আমলে। শহরটির প্রতি সরকারের কড়া নজর ছিল। কারণ একটাই— অসংখ্য বিপ্লবী ছিলেন এই শহরে। বিপ্লবী রবি নিয়োগীর জন্মও জামালপুরের একটি থানায়। শেরপুরে তিনি তার জমিদারির সমস্ত ফসলি জমি কৃষকদের নামে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

সে সময়েও এ শহর খুব পরিচ্ছন্ন ছিল। ভিস্তিওয়ালারা সকাল-বিকাল পানি দিয়ে রাস্তা ধুয়ে দিত। কালিসন্ধ্যায় বাঁশের একটা সিঁড়ি নিয়ে স্ট্রিট লাইট জ্বালানো হতো। রিকশার পেছনে বাতি না থাকলে পুলিশ প্যাঁদানি দিয়ে থানায় ধরে নিয়ে যেত।

খুবই মনোমুগ্ধকর ছিল এই শহর। উত্তরে, এই ছোট শহরের গা ঘেঁষে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ জলে ঝড় তুলে দিবানিশি খলবল করে ছুটে যাচ্ছে, দূর দিগন্ত ছাড়িয়ে। আরো উত্তরে, প্রায় তিরিশ মাইল দূরে, গারো পাহাড়ের সীমাহীন একটা উঁচু-নিচু ধূসর ছবি যেন আঁকা থাকত উত্তর দিগন্তের নীল আকাশে। দক্ষিণ-পশ্চিমে মানুষের বসতি। বাড়িঘর। লেন, বাইলেন বা রোড বলে কোনো জায়গার নাম ছিল না। বিভিন্ন নামের পাড়া ছিল শুধু। যেমন— মিয়াপাড়া, বাজারিপাড়া, আমলাপাড়া, মাঝিপাড়া, আদালতপাড়া, কাচারিপাড়া ইত্যাদি। আর এই পাড়াগুলোর পেছনেই ছিল আদিগন্ত তেপান্তরের মাঠ। খালবিল, ফসলি জমি। এই ধু-ধু মাঠের বুকচিরে মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। মরীচিকা তৈরি করে হারিয়ে গেছে দিগন্তের ভেতরে। কোনো কোনো ট্রেন জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে কলকাতায় চলে যেত। সে জন্যেই বোধহয় স্টেশনের নাম জামালপুর হয়েছে। সিংহজানি জংশন স্টেশনে চব্বিশ ঘণ্টা মানুষের ভিড় লেগেই থাকত।

বর্তমানে এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্রে ভীষণ দুর্ভিক্ষ। চলছে মারাত্মক অবক্ষয়। দর্শক টেলিভিশনে নাটক দেখছেন না, সিনেমা হলে যাচ্ছেন না। মনের মতো কোনো কণ্ঠ নেই বলে গান শুনছেন না। শিল্পকলা একাডেমিতে কী নাটক হচ্ছে দর্শক তার খবর রাখছেন না। একুশের বইমেলায় সৃষ্টিশীল বইয়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। দগ্ধ পাঠক তার বই খুঁজে পাচ্ছেন না। এসব নিয়েই আজ লিখব বলে কলম ধরেছি। কিন্তু তার আগেই জামালপুর নিয়ে এত কথা লিখলাম কেন? একজন শিল্পীর জন্মস্থান। তার পরিবেশ। তার শৈশব-কৈশোর প্রকৃতির কাছ থেকে কতটুকু সাহায্য পেয়েছে? পারিপার্শ্বিক জীবনযাপনের কাছে সে কতটুকু ঋণী? পৃথিবীর সব গুণী শিল্পীই এসব নিয়ে প্রচুর কথা বলেছেন। জামালপুর খুব ছোট্ট শহর। বাংলাদেশের মধ্যে গুণী শিল্পীদের জন্যই এ শহর বিখ্যাত। সবাই একবার থমকে যাবেন জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত শিল্পীদের নামগুলো শুনলে। প্রথম নামটিই হলো সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি-প্রাবন্ধিক হাসান হাফিজুর রহমান, গায়ক ওস্তাদ ফজলুল হক, উপমহাদেশের বিখ্যাত নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা আনোয়ার হোসেন, নাট্যকার-অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার আবদুল্লাহ আল মামুন, কবি ইমামুর রশীদ। এরা সবাই এই শহরের অগ্রজ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। আরো অনেক তরুণ চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, কবি, গল্পকার এই শহরেই জন্মেছেন। তাদের কেউ কেউ এখন ঢাকায় আছেন। কেউ আছেন জামালপুরে। উল্লিখিত অগ্রজ গুণিজনেরা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এখনো বেঁচে আছি শুধু আমি। টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা— একসময় সবক’টাই মফস্বল টাউন ছিল। লেখার সুবিধার্থে আমি শুধু জামালপুরকে মডেল হিসেবে ধরে নিয়েছি।

ব্রিটিশ আমল থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত, এসব মফস্বল টাউন থেকেই শিল্পীরা উঠে এসেছেন। ঢাকায় এসে তারা ঘটিয়েছেন প্রতিভার উন্মেষ। রেডিও-টেলিভিশনে কাজ করেছেন। পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। কেউ কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এ দেশে বিখ্যাত শিল্পীদের একই রকম জীবন। কেউ মফস্বল টাউনের। কেউ অজপাড়াগাঁর। কিন্তু কী আশ্চর্য, সাহিত্য কি কবিতায় কতরকম ছন্দ? কতটা অভিনয়ের ব্যাকরণ শিখলে মঞ্চে জনপ্রিয় হওয়া যায়? গল্প-উপন্যাস লেখার আধুনিক রীতিনীতি, ওই গ্রাম কিংবা মফস্বল টাউন থেকেই কিছুটা শিখতে পারত। তার মানে, সেরকম প্রখর বিদ্বান লোকও ছিল গ্রামগঞ্জে, মফস্বলে থাকেন। নাচের মাস্টার, গান শেখানোর ওস্তাদের অভাব ছিল না। অথচ মাসখানেক আগে আমার এক বন্ধু এসেছিলেন তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। মেয়েটির গানের গলা খুবই ভালো, চমৎকার! কিন্তু মেয়েকে গান শেখানোর জন্য কোনো ওস্তাদ পাচ্ছেন না। ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একজন ওস্তাদ পেলেন না। তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে বলেছেন, মেয়েকে যদি সত্যি সত্যি গান শেখাতে চাও, তাহলে তাকে নিয়ে কলকাতায় যেতে হবে। কিছুদিন থাকতে হবে সেখানে। বন্ধু আমাকে বললেন, কলকাতায় থাকার মতো এত টাকাপয়সা তো আমার নেই। আমার যাওয়া হবে না, মেয়েটার গান শেখাও হবে না। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন আবার সেই মফস্বল টাউনে।

নেই, কোথাও কিছু নেই। সিনেমা হল সব শপিংমল হচ্ছে। আর বাকি যা আছে, তাদেরও প্রোজেকশন মেশিন নেই। প্রোজেকশন মেশিন ভাড়া করে ছবি চালাতে হয়। সে ভাড়াও দিতে হয় প্রযোজককে। সিনেমা হলকে তাই গোডাউন বলতে হচ্ছে। জলতরঙ্গ, অ্যার্কোডিয়ান, সেতার, সরদ বাজানোর মতো অভিজ্ঞ লোক নেই। গান হবে কী করে? বাঙালির ঐতিহ্য যাত্রাপালা বন্ধ। মফস্বল শহরেও এখন আর নাটক হয় না। আমরা তো এ শহরেই বছরে চার-পাঁচবার নাটক করতাম। আমি যখন ঢাকায় এসেছি, তখনো মাসে মাসে নাটক করতাম। বিভিন্ন সরকারি অফিসে নাটক হতো। এমনকি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিদের বিনোদনের জন্যও নাটক করতাম। এখন কোথাও কোনো নাটক হয় না। বছরে উৎসব হতো অনেক। সেসব উৎসবকে ঘিরে গানের শিল্পীরা প্রশংসিত হতেন। এখন আর এত উৎসব হয় না। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে অনেক ক্ল্যাসিক উপন্যাস ছাপা হয়েছে। এখন আর সেই সুযোগ নেই। নাটকে আর অভিনেতার দরকার হয় না। পরিচিত লোকদের নিয়েই নাটক বানানো হচ্ছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে দেখে হঠাৎ কাউকে ডেকে এনে নায়িকার চান্স দেওয়া হচ্ছে। অভিনয় না জানলেও নায়িকা হওয়া যায়। এই হলো শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য, চলচ্চিত্রের অবস্থা। দেশে শিল্প-সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। আছে শুধু রাজনীতি। অথচ রাজনীতির অন্যতম শর্ত হলো, শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকতে হবে। এ ধারণা না থাকলে একজন রাজনৈতিক কর্মী কখনোই রুচিবান রাজনীতিবিদ হতে পারবেন না। এখনকার রাজনীতিকদের শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান কম বলেই ভালো বক্তৃতা দিতে পারেন না। কথামালায় অশুদ্ধ উচ্চারণ থাকে। নতুন চিন্তার খোরাক থাকে না। এজন্যই কি এখনকার রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শনী, পেশি-পুরুষের পদচারণা? চাঁদা আদায়, টেন্ডারবাজি নিয়েই কি ক্যাডাররা ব্যস্ত থাকবেন?

অথচ আমাদের সময়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মীরা শিল্প-সাহিত্যের ভক্ত ছিলেন। আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে তারা সাহায্য করতেন, শ্রদ্ধা করতেন শিল্প-সাহিত্যের মানুষকে। শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়েই তো আমাদের দেশ। সব এক সূত্রে গাঁথা। বিগত সব আন্দোলনে সবাই একসঙ্গে স্লোগান দিয়েছেন, মিছিল করেছেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতি আলাদা হয়ে গেছে। শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা শিল্প-সাহিত্যের মানুষ এখন দলছুট হরিণের মতো দিবানিশি আতঙ্কে কাঁপছি।

আমাদের এই শিল্প-সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ, ক্রমাগত অবক্ষয় এই স্বাধীন দেশে কি সহ্য হয়? হ্যাঁ, একথা ঠিক, আমাদের ভাতের অভাব নেই। সবাই পেটপুরে দু’বেলা খেতে পারছেন। কিন্তু সাহিত্য-চলচ্চিত্র, গান-বাজনা, যাত্রাপালা ছাড়া মানুষ মনের ক্ষুধা কী দিয়ে মেটাবে?

এখনকার রাজনীতি কি জানে, একটি বিদ্রোহী কবিতা শুনেই নিশ্চুপ জনগণ জেগে উঠতে পারে? একটি গান শুনে লাখ লাখ মানুষ মিছিলে আসতে পারে? এখনকার রাজনীতি কি জানে, একটি চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারে? আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য-চলচ্চিত্র নিশ্চুপ মায়ের মতো। আমরা সব সহ্য করতে পারি কিন্তু মায়ের মলিন মুখ দেখতে পারি না। আমরা অসহায়। অপেক্ষায় আছি। দিন গুনছি।

সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads