• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

পরিবার হোক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার পবিত্র নীড়

প্রতীকী ছবি

মতামত

পরিবার হোক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার পবিত্র নীড়

  • প্রকাশিত ১৫ মে ২০১৮

বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়, পরিবার দিবস পালন তেমনই একটি প্রয়াস। তবে ঘটা করে কোনো নির্দিষ্ট দিন মাস বছর নয়, বরং প্রত্যেক দিনই আসলে পরিবার দিবস। আধুনিক কালে এসে মাত্র দুই যুগ ধরে আন্তর্জাতিকভাবে পরিবার দিবস পালন করা হচ্ছে, তবে পরিবারের বয়স কিন্তু দুই যুগ, দুই শতাব্দী বা দুই সহস্রাব্দ নয়। পরিবার হচ্ছে আদিম যুগের আদিম প্রতিষ্ঠান, মানবসভ্যতার মৌলিক প্রতিষ্ঠান, সৌহার্দ্য-ভালোবাসার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। অস্তিত্বের প্রয়োজনে আদিম যুগে মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে বাস করার প্রবণতা ছিল, সেখান থেকেই মূলত পারিবারিক বন্ধনের সৃষ্টি। তখন থেকেই সমাজ গঠনের বিশ্বস্ত ও মৌলিক একক হিসেবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে পরিবার। আধুনিক যুগে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের জোয়ারে পরিবারিক বন্ধন ক্ষয়িষ্ণু। মানুষের পবিত্র আশ্রয়ের অদ্বিতীয় এই সংগঠনটি ভেঙে যাচ্ছে ঠুনকো কারণে, মাঝে মাঝে সভ্যতার এই আদি প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠছে সহিংসতার ভয়ঙ্কর রণক্ষেত্র। পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পারিবারিক অস্থিরতা ও সহিংসতা, যা নিশ্চিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে সংক্রমিত হচ্ছে। বলতে গেলে আজ বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা, তার শিকড় প্রোথিত এই পারিবারিক অস্থিরতায়। সভ্যতার শুরুই হয়েছে যে সংগঠনটিকে কেন্দ্র করে, সেই সংগঠনের ক্রমবর্ধমান অকার্যকারিতা দেখেই হয়তো আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসের ভাবনা মাথায় এসেছে। জাতিসংঘের নির্দেশনায় প্রতিবছর ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। পারিবারিক বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ়করণ ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধিই এ দিবস পালনের লক্ষ্য।

সমাজের মৌলিক ভিত্তিই হলো পরিবার। পরিবারেই শিশু পায় ভবিষ্যৎ জীবনের পথনির্দেশনা, মূলত জীবন গড়ে ওঠে এখান থেকেই। মানুষের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠও বলা হয় পরিবারকে। শিশুর মনোজগৎ প্রস্তুত হয় পরিবারে। পরিবারের ধরন, প্রথা-রীতিনীতি এসবের ওপর ভিত্তি করে শিশুর জীবন-আচরণ গড়ে ওঠে। মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের অন্তরকে বিকশিত করা সর্বোপরি সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলি নিহিত রয়েছে পরিবারের মধ্যেই। একসময় পরিবার বলতে যৌথ পরিবারকেই বোঝাতো এবং সব অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই পরিবার। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পরে পরিবারের ধরন ও ভূমিকায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মেষ এর জন্য দায়ী। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও পরিবারের কাঠামো আগের মতো নেই। সময়, জীবন, জীবিকা, মানসিকতা ও মূল্যবোধের দ্বান্দ্বিক কারণে আমাদের পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে রূপ নিচ্ছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি সবাই মিলে যে সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ ছিল তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে পারিবারের ধরন ও ভূমিকায় যে পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে সামাজিক স্থিরতার বিপরীতে সামাজিক অবক্ষয়ই ঘটছে বলে-কয়ে। ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি হচ্ছে, উন্নত জীবনযাপন ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের দোহাই দিয়ে এই অবক্ষয়কে আমরা স্বাভাবিক পরিস্থিতির স্বীকৃতি দিয়েছি। একান্নবর্তী পরিবারের বদলে এখন ফ্ল্যাটভিত্তিক পরিবারের বিকাশ ঘটেছে। এই ছোট ফ্ল্যাটে পরিবার হয়ে আসছে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর। আত্মীয়দের মধ্যে আত্মায় আত্মায় টানাপড়েনে সামাজিক সম্পর্ক এখানে প্রায় ছিন্নভিন্ন। এমনকি ধরেই নেওয়া হয় এসব একক পরিবারে আত্মীয়ের আগমন অহেতুক বিড়ম্বনা। বাবা-মায়েরও স্থান হয় না এসব ফ্ল্যাট পরিবারে। আগে যেসব কাজকে পারিবারিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো, এখন তা পরিবারের বাইরেই হয়। কারো অসুখ হলে পারিবারিক সেবার চেয়ে হাসপাতালকে প্রাধান্য, শিশুদের লালন-পালন করতে মাতৃক্রোড়ের চেয়ে চাইল্ডকেয়ার সেন্টারকে প্রাধান্য, বৃদ্ধদের পারিবারিক যত্নআত্তি করার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমকে প্রাধান্য- এসব আধুনিক পরিবারের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এগুলোই নাকি আধুনিক সমাজের স্মার্টনেস! উপার্জনক্ষম সদস্যকে পারিবারিক বন্ধনের বাইরে রাখার প্রবণতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। শিশু আর বৃদ্ধরা উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলেই পারিবারিক পরিধির বাইরে চাইল্ডকেয়ার সেন্টার ও বৃদ্ধাশ্রমে তাদের সময় কাটছে। পুঁজিবাদী ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে ব্যস্ত করে তুলছে এই অজুহাতে যদি আমরা পারিবার ব্যবস্থার ক্ষয়িষ্ণু ধারাকে গ্রহণ করি, তাহলে মানুষ আর হিংস্র প্রাণির মধ্যে পার্থক্য অচিরেই উঠে যাবে।

বাংলাদেশের পারিবারিক সহিংসতার নতুন ধারার যে চিত্র, তা অত্যন্ত আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ের পত্রিকার পাতাগুলো পারিবারিক হিংস্রতার ভয়ঙ্কর সব খবরে ভরা। ৩০ বছর ধরে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংসার করে আসা স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়ার কারণে খুন, জন্মদাতা পিতা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষিত, পরকীয়ার কারণে নিজ সন্তানকে হত্যা, নিজ স্বার্থ হাসিলে এবং অন্যকে ফাঁসাতে আপন সন্তানকেই হত্যা, মাদকাসক্ত বা সম্পত্তির লোভে সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যা- এসব ঘটনা এখন প্রতিদিনই ঘটছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ধরনগুলোও ভয়ঙ্কর রকমের আধুনিক! সমাজ থেকে দয়া, মায়া, মানবিকতা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে; সেখানে স্থান করে নিচ্ছে অসহিষ্ণুতা, অসভ্যতা, সহিংসতা ও নৃশংসতা। সামান্য সব কারণকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর সব নিষ্ঠুরতা চলছে পরিবারের মধ্যেই। যে পরিবারকে নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন নিরাপদ আশ্রয়, এখন সেই পরিবারই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ জঙ্গল হিসেবে, অনেক ক্ষেত্রে যেন গুয়ানতানামো কারাগার! বিশ্বায়ন প্রপঞ্চের কিছু সাংস্কৃতিক উপাদান সংসার ভাঙার বিষবাষ্প নিয়ে আমাদের দেশে জমজমাট ব্যবসাও করছে। কিছু ভিনদেশী টিভি চ্যানেল আমাদের এখানে অপসংস্কৃতির শিকড় এমনভাবে গেড়ে বসেছে, যেন এরা নৃশংসতা সৃষ্টির স্থায়ী পাঠশালা। এসব টিভি চ্যানেল পারিবারিক কূটজাল বিস্তারের এক গুরুতর অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

যদিও বাংলাদেশে পরিবারের আকার-প্রকার-কাঠামো নির্ধারণে রয়েছে পুরো একটি মন্ত্রণালয়, সহিংসতা রোধে রয়েছে পারিবারিক সহিংসতা আইন, রয়েছে বিভিন্ন সুরক্ষা বিধিমালা, পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে পারিবারিক আদালত, তবু এসবের সম্মিলিত প্রচেষ্টাও পরিবার নামক পবিত্র আশ্রয়কে পবিত্র রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। পরিবার থেকে কোনো সন্তান যদি ‘কোয়ালিটি টাইম’ না পায়, তবে যত শক্ত আইন-কানুনই প্রয়োগ করা হোক না কেন, তা পারিবারিক সৌহার্দ্য নিশ্চিত করতে পারবে না। পারস্পরিক সময় না বের করতে পারলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য তৈরি হবে না। পরিবার নিয়ে নৃবিজ্ঞানীরা প্রথমেই যে কথাটি বলেন, তা হচ্ছে- ‘পরিবার সভ্যতার আদি বিদ্যাপীঠ’। তা-ই যদি হয়, তাহলে এই আদি বিদ্যাপীঠকেই কার্যকর এবং এখান থেকেই মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা চাইল্ডকেয়ার সেন্টারে আশা করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। পরিবারের গুরুজনকে পরিবারের মধ্যেই রাখতে হবে, না হলে পরিবারের নবীন সদস্যরা ঐতিহ্যজ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে বঞ্চিত হবে।

পরিবার মানুষের পবিত্র আশ্রয়, মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই আশ্রয়ের পবিত্রতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের ব্যক্তিগত ঠিকানা যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে তার বৈশ্বিক ঠিকানা নিশ্চিতভাবেই অনিরাপদ হয়ে উঠবে। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজনে পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব স্তরেই সংশ্লিষ্ট সবাইর নিজ নিজ দায়িত্ব পালন জরুরি। তবে পরিবারকে উপেক্ষা করে সমাজের অন্য কোনো মাধ্যমকে যদি প্রাথমিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করা হয়, তাহলে তা হবে গাছের গোড়া কেটে ডগায় পানি দেওয়ার নামান্তর। এই অপকর্মটি এখন শহরজুড়ে চলছে, ক্রমেই গ্রামে বিস্তৃত হচ্ছে। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, পারিবারিক ভালোবাসার পরিধি একেবারেই ভেঙেচুরে গেছে, মূল আশঙ্কাটি হলো ভালোবাসার এই পরিধি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে এবং সেই সংকোচনের জায়গাটি নৃশংসতা দ্বারা মহাসমারোহে দখল হচ্ছে।

আগেই বলেছি, পরিবার শুধু একটি দিবসের ব্যাপার নয়, পরিবার চিরকালের, চিরপবিত্রতার, চির ভালোবাসার। শুধু দিবস পালন করে পরিবারকে সুখী বা শান্তিময় করা সম্ভব নয়। তবে একটি সুন্দর পরিবার, সুখী পরিবারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। কারণ পরিবার অস্থির হলে অস্থির হয়ে পড়বে পুরো বিশ্ব। পবিত্রতার বন্ধন, মূল্যবোধের বন্ধন, ভালোবাসার বন্ধন, সৌহার্দ্যের বন্ধন, সততার বন্ধন, মানবিক বন্ধন- এ সবই পারিবারিক বন্ধনের বিস্তৃত রূপ। আবার বৈশ্বিক নিষ্ঠুরতা, বৈশ্বিক নৃশংসতা, বৈশ্বিক কপটতা পারিবারিক অচলতার বিস্তৃত রূপ। সুতরাং শান্তিময় পৃথিবীর আশা করলে পরিবারের ভালোবাসা ও মমতার বন্ধনে বেঁচে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হবে অনেক কিছুর; পরিবারেরও। তবে সেই পরিবর্তন যেন মনুষ্যত্বকে নষ্ট না করে। একেকটি পরিবার যেন না হয় সহিংসতার গোলাবারুদ, একেকটি পরিবার যেন না হয় গুয়ানতানামো কারাগার। পরিবার যেন হয় সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার পবিত্র নীড়।

মো. মনিরুল ইসলাম

লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

monirulislamprism@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads