• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

তিস্তা চুক্তি নিয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটুক

  • আমিরুল মোমেনীন
  • প্রকাশিত ১৭ মে ২০১৮

কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতনে দুই বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। এখানে থাকবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নানা ইতিহাস, গ্রন্থাগার, মিলনায়তন, বাংলাদেশ সম্পর্কে গবেষণার নানা তথ্য, চিত্রশালাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা স্মারক। থাকছে রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ অবস্থানের নানা তথ্য, ইতিহাস, স্মারক ও চিত্রাবলি। ২৫ মে ভবনটি যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও উপস্থিত থাকবেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের পৃথক বৈঠক হওয়ার কথা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে এদেশের মানুষের মনে এক ধরনের শিহরণ জাগে। তারা আশায় বুক বাঁধেন, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে এবার একটা ফয়সালা হবেই। কিন্তু দুই সরকার এ ব্যাপারে খুব কাছাকাছি আসার পর প্রতিবারই তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি, যিনি নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু বলে দাবি করেন। মনমোহন সিং সরকারের শেষ সময়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য নিয়ে মনমোহন বাংলাদেশে আসেন ২০১১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু কথা দিয়েও মমতা ব্যানার্জি ঢাকায় না আসায় চুক্তিটি হয়নি। এতে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সুবিধা হতে পারে ভেবে মমতা একেবারে শেষ মুহূর্তে সরে যান বলে গুঞ্জন রয়েছে। বাস্তব সত্য অনেকটাই লুকানো।

ভারত বিভাগের সময় পানির বিষয়টি সম্ভবত পাকিস্তানের স্রষ্টাদের মাথায় ছিল না। গোটা পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সবকটি নদীর পানির উৎসই ভারত ভূখণ্ডে চলে যায়। ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল ভারতে অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাঞ্জাব পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবের বিভিন্ন ক্যানেলে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলে তাদের টনক নড়ে। পশ্চিম পাঞ্জাব কৃষিপ্রধান এলাকা। এখানকার ভূমি উর্বর, ফসলও হয় প্রচুর। কিন্তু তার জন্য চাই পানি। সেই পানি আসে ভারত থেকে প্রবাহিত সিন্ধু নদ এবং তার পাঁচটি উপনদীর মাধ্যমে। পাকিস্তান দ্রুতই বুঝতে পারে দেশবিভাগের ফলে তারা এক মহাসঙ্কটে পড়েছে। অবশেষে তারা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে সক্ষম হয় বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায়। ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের করাচি নগরীতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী, পূর্বদেশীয় তিনটি নদী— বিপাশা, রাভি ও শতদ্রুর নিয়ন্ত্রণ ভারতকে দেওয়া হয়; অন্যদিকে পশ্চিমের তিনটি নদী— সিন্ধু, চন্দ্রভাগা এবং ঝিলামের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানকে দেওয়া হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধুর মাত্র ২০ শতাংশ পানি ভারত ব্যবহার করতে পারে। দুই দেশের মধ্যের সম্পর্কে দীর্ঘ উত্থান-পতন এলেও টিকে রয়েছে এই চুক্তিটি। কিন্তু ২০১৬ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার পর ভারত ওই চুক্তি থেকে সরে আসতে চায়। এই পানির বেশিরভাগ ব্যবহার করে জম্মু-কাশ্মীরের সেচ এলাকায় নিয়ে যাওয়ার মনস্থ করেন তারা। তবে পাকিস্তানের মতে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভারত কখনো একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে না। এটা করা হলে তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে। এ ধরনের হুশিয়ারির পর বিষয়টি ক্রমশ চাপা পড়ছে। পানি বিশেষজ্ঞরা অবশ্য অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির ওপর দখলকে কেন্দ্র করে। এ কারণেই হয়তো ভারত এখনই এ ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

অপরদিকে ছোট-বড় প্রায় সাতশ’ নদী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর সবকটির উৎসই ভারত। এসব নদী বিশেষ করে গঙ্গা ও তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে তারা পানি প্রত্যাহার করছে। এতে এ দেশের নদ-নদীগুলো ক্রমশ শুকিয়ে মরুভূমির রূপ নিয়েছে। গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটা চুক্তি হলেও তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিটি হয়েও হচ্ছে না। তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মতো সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগেরও প্রধান নদী। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভারত তিস্তা নদীর উজানে জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। সিকিম হিমালয়ের ৭ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীটি সৃষ্টি হয়েছে। এটি দার্জিলিংয়ে অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত এই ধারাটি বিভিন্ন নদীপ্রবাহের মাধ্যমে গঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতো। ১৭৮৭ সালের অতিবৃষ্টি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল এবং সে সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার, তার মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তিস্তা এবং এর অংশবিশেষ এখনো বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত। তিস্তার মাসিক গড় পানি অপসারণের পরিমাণ ২ হাজার ৪৩০ কিউসেক। ২০১৪ সালে তিস্তার ভারতীয় অংশে গজলডোবায় স্থাপিত বাঁধের সবগুলো গেট বন্ধ করে দেওয়া হলে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে পানিপ্রবাহ শূন্যে নেমে আসে। এর ফলে বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকায় মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে ওই বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে একটি প্রতিবাদী জনযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনযাত্রার মুখে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিছু পানি ছাড়লে বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্টে পানি স্বল্প সময়ের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

এর আগে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে স্থির হয় যে, তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীটিতে সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি হবে, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। এর প্রায় ২৪ বছর পর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত একটি যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের মধ্যে সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করে জানায়, বাংলাদেশ ভারতের সমান পানি পেতে পারে না। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল পানিপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তায় আসতে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে প্রথম ভারত তিস্তার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে তিস্তা ডালিয়া ব্যারাজে উজান থেকে আসা পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে অবশ্য নানাবিধ আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও ভারত সে সব আইন আমলে নিচ্ছে না। অন্যদিকে চিরশত্রু পাকিস্তানের বেলায় তারা কঠিন হতে পারছে না। বিষয়টি আমাদের বেদনা দিচ্ছে। ভারতের এহেন মনোভাবের কারণে তিস্তা-তীরবর্তী ও আশপাশের প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। তলদেশে অজস্র নুড়িপাথর, বালি আর পলি জমা পড়েছে। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলে প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখারি হচ্ছে। তিস্তা বাঁধের কারণে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ভারতও। দার্জিলিংয়েও ভাঙন শুরু হয়েছে। সেখানে বড় বড় পাহাড় ধসে পড়ছে এবং বাসিন্দারা তিস্তার বাঁধ অপসারণের দাবি জানাচ্ছে। এমনকি মমতা ব্যানার্জিও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে নারাজ। কারণ শুধু বিজেপি নয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার উপকৃত হয় এমন কোনো কাজ করতে তার অনীহা রয়েছে। কারণ হিসেবে ধারণা করা যায়, তার ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশবিরোধী। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময়ই এটা আঁচ করতে পারা যায়। মুসলমান হলেও ওই সময় তারা কোনো মুসলমান এমনকি আত্মীয়দেরও আশ্রয় দিতে চায়নি। বিশেষ করে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের এই নেতিবাচক মনোভাব আরো প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় পাচ্ছে বলে অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু মমতা এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। জম্মু ও কাশ্মীরের পর পশ্চিমবঙ্গেই মুসলমান বেশি, শতকরা ২৭ ভাগ। এদের অধিকাংশই মমতার ভক্ত। তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে না চাওয়াই স্বাভাবিক। এ বছরই বাংলাদেশে নির্বাচন। তিস্তা চুক্তি হলে আওয়ামী লীগ উপকৃত হতে পারে এই ভেবে তারা হয়তো বাদ সাধছেন। তাদের চটাতে চান না মমতা। বিজেপির অবস্থাও প্রায় একইরকম। পশ্চিমবঙ্গে তারা ক্রমশ খুঁটি গাড়ছে। এখানে তারা ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছে। তাদেরও মুসলমান ভোট দরকার। ইতোমধ্যে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে। তাই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলকে আগপিছু ভাবতে হচ্ছে। তবে সবকিছুর মতো নদ-নদীরও একটা ধর্ম আছে। আর তা হচ্ছে— তারা কোনো বাধা সইতে পারে না। এমনকি নদীর ওপর সেতুও তারা সহ্য করে না, প্রতিশোধপরায়ণ হয়। আশপাশের ভূমির নিচে ঢুকে পড়ে, মাটির স্তর ফাঁকা করে দেয়, দূরে ভাঙনের সৃষ্টি করে। এমন সর্বনাশ শত্রুর জন্যও কাম্য নয়। দেশবাসী সবসময় আশাবাদী, আশা নিয়েই তারা বেঁচে আছে। তাদের প্রত্যাশা মমতা দিদির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হোক। তিনি সদয় হোন। বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ মে’র বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তির বিষয়টি উত্থাপন করবেন। মমতা ব্যানার্জি তাতে আগ্রহ দেখাবেন। মমতা বার বার বলেছেন তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। এবার তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন, এটাই প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads