বাংলাদেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে শিশুশ্রম। হাজার হাজার শিশু শ্রম দিচ্ছে কল-কারখানায়, গ্যারেজে, হোটেলে, রিকশা-টেম্পোর ওয়ার্কশপে। আবার অনেক শিশুকে দেখা যায় বাস ও টেম্পোর হেলপারগিরি করতে। পরিবারের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা আর দারিদ্র্যের জন্যই প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে এ শিশুশ্রম। যে বয়স বন্ধুদের সঙ্গে হেসে-খেলে স্কুলে কাটানোর; জীবিকার তাগিদে আজ সে বয়সে কোমলমতি শিশুরা মুখোমুখি হচ্ছে কঠিন বাস্তবতার! যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই-কলম, সেই বয়সেই তারা হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে কঠোর শ্রমের হাতিয়ার। নিজের কিংবা পরিবারের দুমুঠো অন্ন জোগাতে এ শিশুরা যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন পেশায়। এদের মধ্যে অনেক শিশুই ঝুঁকির্পূণ পেশায় নিয়োজিত। শিশুশ্রম নিরসনে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। আমাদের দেশে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের বৃহৎ একটি অংশ বিদ্যালয়ে যায় না। প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে স্কুলে গমন করতে পারে না। অনেকেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও চালিয়ে যেতে পারে না তাদের পড়ালেখা। আর তাই অর্থাভাবে মাঝপথে থেমে যায় তাদের পড়াশোনা; বেছে নিতে হয় জীবন রক্ষার পথ। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গিয়ে বিসর্জন দিতে হয় তার ভবিষ্যৎ গড়ার শিক্ষাজীবন। দেশের বিভিন্ন মাছের আড়তে মাছের ভাঁড়শ্রমিক, ওয়ার্কশপের হেলপার বা কারিগর, মিস্ত্রি, মাটিকাটা, রিকশা চালানো, গাড়ির হেলপার, ঠেলাগাড়ি-ভ্যানগাড়ি চালানো, হোটেলবয়সহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে এসব কোমলমতি শিশু।
বাংলাদেশে ২০ লাখ গৃহশ্রমিকের মধ্যে ৯৩ শতাংশই অর্থাৎ ১৮ লাখ ৬০ হাজার শিশুই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এসব গৃহশ্রমিক মানসিক, শারীরিক নির্যাতন ও আর্থিক শোষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ ধরনের কাজ করে থাকে শিশুরা। এসবের মধ্যে ৪৫টির বেশি কাজই হচ্ছে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। শ্রমিকের বৃহৎ একটা অংশ হচ্ছে পথশিশু। বেঁচে থাকার তাগিদে এরা নিজেদের শ্রম বিভিন্নভাবে বিক্রি করে থাকে। পথশিশুদের বৃহৎ অংশ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে যায়। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ। শহরে কাজ করে থাকে ১৮ লাখ ও গ্রামে ৬৭ লাখ শিশুশ্রমিক। এসব শিশুশ্রমিকের মধ্যে ৪৭ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও আইএলওর জরিপ মতে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে ৪৫ ধরনের। তন্মধ্যে শিশুরা ৪১টি কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। যারা গৃহ-পরিচালিকার কাজ করছে তাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে গৃহ-পরিচালিকার ৮৬ শতাংশ মেয়ে। ৩০ শতাংশের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর আর বাকিদের বয়স ১২ থেকে ১৬ পর্যন্ত। এরা প্রতিদিন ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করে থাকে।
শিশুশ্রম বন্ধের জন্য মূলত প্রয়োজন গণসচেতনতা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। শিশুশ্রমিকরা কাজে নির্ধারিত সময়ের চাইতে অনেক বেশি সময় দিলেও সে অনুযায়ী তারা তাদের শ্রমের দাম পায় না। কাজের চাপ থাকে প্রচুর, ফলে ঠিকমতো খেতেও পারে না। গৃহকর্ত্রীর ছেলেমেয়েরা রোজ ঠিকই স্কুলে যাওয়া-আসা করে, কিন্তু কখনো চিন্তা করেনি কাজের মেয়েটির কথা। অনেক সময় কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে নীরবে কান্না করে থাকে কিশোরীরা। গৃহকর্ত্রীর চোখ রাঙানিতে কাজের মেয়েরা অনেক সময় প্রতিবাদ করতে চাইলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মারধর বা নানা রকমের অত্যাচার করে থাকে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও হাত তোলে এসব অসহায় শিশু শ্রমজীবীর কোমল শরীরে। অনেক সময় গৃহকর্ত্রীর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় কোমলমতি শিশুরা, যা পত্রিকার খবরে পরিণত হয় হরহামেশা। জাতীয় শিশু নীতি ২০১১-এর ৮ ধারার ৮.৯-এ বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুরা নিয়োজিত আছে, সেখানে শিশুরা যেন কোনোরূপ শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এর ভিন্ন চিত্র। নিজেদের সন্তানকে দেখেন স্নেহ-মায়া-মমতার দৃষ্টিতে আর কাজের মেয়েটির প্রতি যত্ন নেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলেন গৃহকর্ত্রীদের অধিকাংশই, নির্যাতন করেন নানাভাবে। এ থেকে উত্তরণে সব শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন সচেতনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ।
সারাদেশের রেলওয়ে এলাকায়ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শিশুকুলিদের দল। এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ফলে এদের মন-মানসিকতার বিকাশ হয় না বরং কুসঙ্গে থাকার ফলে এরা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বা অপরাধচক্রে জড়িয়ে যায়। সিগারেট, ইয়াবা ও নানা প্রকার মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবনে এসব শিশু শ্রমিক অল্প বয়সেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজের মন্দা হলে এরাই বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের মধ্যে অন্যতম হলো ‘ওয়েল্ডিং’য়ের কাজ। ‘ওয়েল্ডিং’ কাজে অনেক শিশু কাজ করতে গিয়ে চোখে আঘাত পেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। অসুস্থ হয়ে পড়লে এদের কোনো খোঁজ-খবর নেয় না মালিকপক্ষ! সুতরাং দেশের শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্টভাবে আইনের প্রয়োগ ও কঠোর শাস্তির বিধান।
চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় কিন্তু শিশুশ্রম সমস্যার সমাধান নেই, নেই কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯)-এ স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাংলাদেশ। ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয় বটে কিন্তু আদৌ কি সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের দেশে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? শুধু গ্রাম বা মফস্বল শহর নয়— ঢাকাসহ সারা দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। দেশের শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেড়েই চলছে শিশুশ্রম। শিশুশ্রম নিবারণ করতে হলে প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন দফতরের সমন্বিত উদ্যোগ আর সমাজের সর্বস্তরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। তবেই শিশুশ্রম বন্ধ হবে। শিশুদের হাতেই জাতির উন্নয়ন সম্ভাবনার চাবিকাঠি। তাই শিশুদের গড়ে তুলতে হবে আমাদেরই। শিশুরা জাতির সেরা সম্পদ। আজ যারা শিশু, আগামীকাল হবে তারাই দেশ গড়ার সৈনিক। শিশুকে তার প্রাপ্য পূর্ণ অধিকার দিয়ে গড়ে তুলতে পারলেই সার্থক হবে বাংলাদেশ।