• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বারুদে পোড়া বিপন্ন মানুষের কথা

বিপন্ন মানুষের কথা

আর্টিস্ট : রাকিব

মতামত

বারুদে পোড়া বিপন্ন মানুষের কথা

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০১৮

দীর্ঘশ্বাসগুলো— অগ্নিদগ্ধ ধোঁয়ার কুণ্ডলী। কল্পনাগুলো— রক্তাক্ত, বীভৎস মানবদেহের। স্বপ্নগুলো— বারুদের আগুনে দাপাদাপি করা আর্তনাদ। অনুভূতিগুলো— মারণাস্ত্রের পেছনে লুকিয়ে থাকা মানুষের ছায়া।

চলছে যুদ্ধ আর যুদ্ধ। আহা, সব-ই যে ঘটিয়ে চলেছে মানুষ, মানুষের বিরুদ্ধে। কোথাও বইছে রক্তগঙ্গা, কোথাও বইছে প্রাচুর্যের বন্যা। আর একদিকে না খেয়ে মরছে যুদ্ধ ও শোষণ লাঞ্ছিত মানুষ। অনুভবে গেঁথে যাওয়া এই চিত্র মুসলিম বিশ্বের।

সন্ত্রাস দমন আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে ইসলামী বিশ্বে চেপে বসেছে ধ্বংসের দানব। মুসলিমপ্রধান দেশগুলো একটার পর একটা আক্রান্ত হচ্ছে। আজকের টার্গেট এই দেশে তো, কাল সেই দেশ। এইভাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় চলছে টার্গেটেড তাণ্ডব। নব্বইয়ের দশক থেকে এই অস্থিরতা শুরু হলেও সন্ত্রাস দমনের অজুহাত তৈরি হয় ওয়ান-ইলেভেনে টুইনটাওয়ারে হামলার পর থেকে। সন্ত্রাস দমনের এই অভিযানে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। গুটিকয়েক লোকের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অজুহাতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ সাধারণ মুসলমানদের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে চলছে মুসলমান নিধনের এই প্রক্রিয়া।

মুসলমানদের মতানৈক্যের ফাঁকফোকরে আগেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনে নিয়েছিল তারা। কথিত আছে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিভক্ত করতে ধর্মের প্রকৃত তথ্য বিকৃত করে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ প্রচারে তাদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা রয়েছে। যে কারণে ভ্রান্তপথে ধর্ম রক্ষার অজুহাতে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে মুসলমানদের একটি অংশ। তাদের কেউ কেউ বেহেস্ত পাওয়ার আশায় আত্মঘাতী হতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না।

ভ্রান্ত জিহাদের মোড়ক দিয়ে মুড়িয়ে বদনাম করা হচ্ছে শান্তির জন্য প্রশংসিত ইসলামের। ধ্বংস করা হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের হাজার বছরের আদর্শ আর নৈতিক মূল্যবোধ। শান্তি প্রক্রিয়ার বিপরীতে শক্তিমানরা একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে চলেছে ইসলামী বিশ্বের উর্বর দেশগুলোতে। বলা চলে, প্রায় প্রতিদিনই মুসলিম বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে লাশের সারি বাড়ছে। ইসলামী বিশ্বের সোনালী জমিন যেন ঢেকে যাচ্ছে সারি সারি কফিনে।

বসনিয়া, কুয়েত, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া আর মিয়ানমারের রাখাইনে লাখ লাখ মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আর সাত দশক ধরে মুসলমান হত্যার এক কসাইখানা বানিয়ে রাখা হয়েছে ফিলিস্তিনকে। তাদের যুদ্ধনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিরপরাধ নারী, শিশু ও সাধারণ মুসলমানও রেহাই পাচ্ছে না বোমার নিশানা থেকে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছে ওরা। সমরাস্ত্রে শক্তিধর দেশগুলোর অঙ্গুলি নির্দেশে বোবা হয়ে আছে বিশ্ব বিবেক।

নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া যুদ্ধে প্রায় আট হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ইরাক যুদ্ধেও দশ লাখের বেশি মুসলমান নিহত হয়। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমেরিকা আফগান যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা বলা হয়ে থাকে এক লাখের বেশি। এর মধ্যে নিহত আমেরিকান সৈন্যসংখ্যা ২০১৫ জন। বাকি নিহতদের অল্প সংখ্যক তালেবান জঙ্গি আর আফগানিস্তানের নিরীহ সাধারণ মুসলমান। এপির রিপোর্ট অনুযায়ী লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে হামলায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার। এই যুদ্ধেও অনেক বেসামরিক মুসলমান নিহত হয়। আবার গত সাত বছরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা প্রায় দশ লাখের কাছাকাছি। নিহতদের বেশিরভাগই নিরপরাধ নারী, শিশু ও বেসামরিক মানুষ।

এ ছাড়া ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞে কত হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তথ্যে মৃতের সংখ্যা হাজার নয়, লাখ ছাড়িয়েছে। গুলি, বোমা, অগ্নিসংযোগ আর ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। নারী ও মেয়েশিশুদের হত্যার পূর্বে ধর্ষণের লোমহর্ষক চিত্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পৈশাচিক চরিত্র উন্মোচন করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত এই নিধনযজ্ঞকে জাতিসংঘ নৃশংসতার ধ্রুপদী উদাহরণ বলে উল্লেখ করে।

অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের উসকানিতে ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৪০ লাখ এখন দেশের বাইরে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছে। ইরাকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে গৃহহারা মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। সিরিয়া ও ইরাকের বাস্তুচ্যুত মানুষের এক অংশের দেশত্যাগের নেপথ্যে রয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের প্রসার এবং সংগঠনটির নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে আসা অসহায় মানুষেরা তুরস্কে, জর্ডানে, লেবাননে, মিসরে এমনকি ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। আবার নিরাপদে বেঁচে থাকতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কত মানুষ সাগরে ডুবে মারা গেছে তারও হিসেব নেই। অনেক দেশ আবার মানবিক দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে অনেক অভিবাসন প্রত্যাশীদের অনেককে আশ্রয় দিয়েছে।

নব্য ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের দুনিয়াজোড়া যুদ্ধ, কলহ আর বোমার লক্ষ্যস্থল যেন ইসলামী দেশ ও মুসলমানরা। কীভাবে মুসলমানদের ধ্বংস আর বিপন্ন করা যায়, চারিদিকে চলছে যেন তারই চক্রান্ত। কেউ সর্প হয়ে দংশন করছে কেউ আবার ওঝা হয়ে ঝাড়ছে। একদিকে ধর্মীয় উগ্রতার বদনাম দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কৌশলে, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে প্রতিরোধের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে নির্বিচারে।

অপরদিকে, দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে ইসরাইল। সর্বশেষ গত সোমবার ১৪ মে ইসরাইলিদের গুলিতে অন্তত ৫৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২ হাজার ৭০০ জন। ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর একদিনে ফিলিস্তিনি হতাহতের এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যা।

ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বিলাসী জীবন যাপন করে চলেছেন মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতা। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর ধর্মীয় বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে হীন স্বার্থের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সহজ-সরল মুসলমানদের মনে প্রবেশ করানো হয়েছে ধর্মীয় উগ্রতার বীজ। এসব কাজের ব্যবহার করা হচ্ছে একশ্রেণির কাণ্ডজ্ঞানহীন ও চতুর শিক্ষিত ব্যক্তি বা যুবকে। এরা জিহাদের নামে বেহেস্তের টিকেট দিলেও নিজেরা সেই বেহেস্তে যেতে আগ্রহী নয়। ধর্ম রক্ষার নামে প্রতিবাদের নেশায় বিভ্রান্তির পথে বেহেস্তে যেতে আকুল হয়ে ওঠে কিছু সহজ-সরল মুসলিম যুবক। যারা নিজেদের অজান্তে সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক হয়ে নিজেদেরই ধ্বংস করে চলেছে। যে বিষে আক্রান্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এখন ধ্বংসের পথে। অথচ একসময় এই ধর্মাবলম্বীরাই পৃথিবী শাসন করেছিল।

প্রাসঙ্গিক বলে ইসলামে যুদ্ধনীতির বিষয়ে একটি আলোচনা করছি। যুদ্ধের ওপর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর যেসব নৈতিক শিক্ষা ও সহানুভূতিশীল নির্দেশ ছিল তা তখনকার আরববাসীদের প্রতিশোধ ও ক্রোধের আগুন নেভানোর বদলে চরিত্র সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড, হেদায়েত ও কল্যাণ লাভের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। রসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোথাও কোনো বাহিনী পাঠাতেন তখন তাদের প্রতি হেদায়েত থাকত, ‘আমি তোমাদের আল্লাহকে ভয় করার এবং যেসব মুসলমান তোমাদের সঙ্গে রয়েছে তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণের উপদেশ দিচ্ছি। তোমরা আল্লাহর নামে যুদ্ধরত হবে এবং আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে— যারা আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করেছে। কোনো শিশু, নারী, অসহায় বৃদ্ধ কিংবা খানকাহ, গির্জা, মঠ, মন্দিরের ধর্মীয় পুরোহিত, বিশপ- যারা কোনো না কোনো ধর্মের সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে তাদেরকে হত্যা করবে না। কোনো গাছ কাটবে না, কোনো গৃহ ধসিয়ে দেবে না।’

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুসলমানদের প্রতি বিচারহীনতার কারণেও উগ্রবাদ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আবার সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে সাধারণ মুসলমান নিধনের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। এ প্রক্রিয়া উগ্রতাকে আরো উসকে দেওয়া বা দমনের নামে মুসলমানদের বিপন্ন জাতিতে পরিণত করারই কৌশল।

লেখক : সাংবাদিক

ই-মেইল : ofshamimbd@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads