• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ভেজালের দৌরাত্ম্য কি চলতেই থাকবে

আমে ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

ভেজালের দৌরাত্ম্য কি চলতেই থাকবে

  • প্রকাশিত ২১ মে ২০১৮

সরবে কোনো হত্যার ঘটনা কিংবা খারাপ কিছু করা হলে তা দেখা যায়, বোঝা যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কেউ নীরবে কোনো প্রাণঘাতী কাজ করতে থাকলে তা সহজে মানুষ বুঝতে পারে না। যারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকাশ্যে ছিনিমিনি খেলছে তারা খুনি অপরাধীর থেকে কম ভয়ঙ্কর নয়! সত্যি বলতে কি, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি এখন ঠুনকো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানহীন পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ার কারণে এমনটি ঘটছে। রমজান মাস চলছে। এ সময় ফল-ফলাদি, তরল খাদ্য ও শাক-সবজির চাহিদা বেশি থাকে। এর ওপর আবার জ্যৈষ্ঠ মাস। ফলের বাজার ভেজালমুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি।

বাস্তবতা হলো বাজার, দোকান, সুপার শপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। আগের দিনে মানুষকে বলতে শোনা যেত, কোনো কোনো খাদ্যে ভেজাল আছে। আর এখন বলতে শোনা যায়, কোনো কোনো খাদ্য ভেজালমুক্ত। মাছে ও দুধে ফরমালিন। প্রায় সব ধরনের ফল-ফলাদিতে দেওয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। বিস্কুট, সেমাই, পাউরুটি, নুডলস ইত্যাদিতে মেশানো হচ্ছে কাপড়ের রং। শাক-সবজিতে রাসায়নিক, কীটনাশক। জিলাপি-চানাচুরে মবিল। মুড়িতে ব্যবহার হচ্ছে ইউরিয়া। চিনি, আটা ও ময়দায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত চক পাউডার। শিশুখাদ্য দুধও ভেজাল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অতিরিক্ত রেডিয়েশনযুক্ত দুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই আমদানি করা হচ্ছে দেদার। দুধে ফরমালিন, স্টার্ট, সোডা, বরিক পাউডার মেশানো হচ্ছে। প্যাকেটজাত তরল দুধও নিরাপদ নয়। সয়াবিন তেলে অতিরিক্ত অ্যাসিটিক অ্যাসিড, পাম অয়েল ও ন্যাপথলিন মেশানো হচ্ছে। ছানার অতিরিক্ত পানির সঙ্গে ভাতের মাড়, এরারুট আর কেমিক্যাল মিলিয়ে তৈরিকৃত সাদা তরল পদার্থকে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘গাভীর দুধ’। কার্বাইড দিয়ে পাকানো হচ্ছে ফলমূল আর সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন। নোংরা পানির ব্যবহারসহ ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে আইসক্রিম। মধুতেও ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। এখন খাঁটি মধু পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। মোড়কজাত ফলের জুসে বিষাক্ত রং ও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে।

কোনো কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবনরক্ষাকারী পানিও আজ নিরাপদ নয়। শহর এলাকায় যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর, ডোবা এবং ওয়াসার পানি কোনো রকমে ছেঁকে বাজারজাত করা হচ্ছে। সে পানিতে থাকছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড, ই-কোলাই। এ ছাড়া এগুলো আবার বিশুদ্ধ নামিদামি কোম্পানির সিলমোহর দিয়ে দেদার চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশি-বিদেশি কোনো ফল কেনার আগে ক্রেতাকে তিনবার ভাবতে হচ্ছে। সব ধরনের ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং তা উজ্জ্বল করতে ক্ষারজাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ইট, সিমেন্ট, রড থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকসামগ্রী যে মানসম্মত পাওয়া যাবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, বডি লোশন, বডি স্প্রে, পারফিউম, পাউডার, ক্রিমসহ নানা প্রসাধনসামগ্রীতেও আজ ভেজালের জয়জয়কার! বেশিরভাগ পণ্যে এখন নিরাপত্তা আবরণ না থাকায় গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় ঢাকা শহরের অধিকাংশ জারের পানিতে মলের জীবাণু পাওয়া গেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামালে সুতা রাঙানোর বিষাক্ত রং, ভেজাল পাম তেল, সেন্ট, পচা ডিম ইত্যাদি মিশিয়ে ভিন্ন নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণবিষয়ক সমীক্ষা’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পথখাবারেই ই-কোলাই, সারমোনেলা ইস্ট মোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ স্ট্রিট ফুড বা পথখাবার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে তৈরি করা হয় না। এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। বাজারে চর্ব্যচূষ্যলেহ্য এমন পণ্য পাওয়া কঠিন যেখানে ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদান নেই। ভেজাল ও বিষেভরা খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার কারণে কিডনি ও লিভারে সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। বর্তমান সময়ে এমন পরিবার খুব কমই পাওয়া যাবে, যে পরিবারে কিডনি, লিভার কিংবা পেটের সমস্যাজনিত কোনো রোগী নেই! ভেজাল খাদ্য ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করে। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার কারণে শিশুদের হার্টের সমস্যা সৃষ্টিসহ দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে। গর্ভজাত মায়ের শিশুও বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। দুঃখের বিষয় সারা দেশ মানহীন, অবৈধ, নকল খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যে সয়লাব হলেও ‘বিএসটিআই’র কোনো মাথাব্যথা নেই! অনেকে আবার  বিএসটিআইর লোগো ছাপিয়ে নকল-মানহীন পণ্যের সঙ্গে লাগিয়ে  বাজারজাত করছে।

ভেজাল পণ্যের ক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে ওষুধ খেলেও কাজ হচ্ছে না। সেখানেও ভেজাল। দেশজুড়ে অবাধে বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের নকল ও ভেজাল ওষুধ। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রস্তুতকারক, প্রক্রিয়াজাতকারক, সরবরাহকারী সবাই এই ভেজাল প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ক্ষেত থেকে শাকসবজি তুলে অপরিষ্কার নালা-ডোবায় ধোয়া হচ্ছে। ফলে পানিতে থাকা জীবাণু শাকসবজিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। পোল্ট্রিসহ পশু মোটাতাজাকরণে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াও ব্যবহার করা হচ্ছে স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন। মাংস ও দুধের মাধ্যমে তা কোনো না কোনোভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। ভেজালের এই দৌরাত্ম্য কি চলতেই থাকবে? শুধু মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালালে হবে না, নিয়মিতভাবে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করতে হবে। নকলবাজ কারখানা ও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু মানুষের জীবনে নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধছে। রোগপূর্ণ জীবন উপভোগের ও আনন্দময় হচ্ছে না। ভেজাল বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা ও সচেতনতাই যথেষ্ট। প্রতিবছর প্রয়োজনের অতিরিক্ত তিন-চারগুণ ফরমালিন আমদানি করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অতিরিক্ত ফরমালিন কোথায় যায়?

এদেশে ভেজাল কিসে নেই! অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পিএইচডি ডিগ্রির ক্ষেত্রেও এদেশে ভেজাল দেখা যায়! এদেশে শিক্ষাসনদ জাল করেও অনেকে দেদার চাকরি করে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎপর হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। ভুয়া ডাক্তার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়দানকারী ভুয়াবাজির ব্যবসা চলছে ব্যাপক! সব ধরনের ভেজালের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি ও সবার সুন্দর জীবনের স্বার্থে ভেজালবিরোধী অভিযানে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে।

সাধন সরকার

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

sadonsarker2005@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads