• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
পুরনো কথার পিঠে...

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এখন সচেতনতা এখন অনেক তুঙ্গে।

আর্ট : রাকিব

মতামত

পুরনো কথার পিঠে...

  • প্রকাশিত ২২ মে ২০১৮

বাংলাদেশ যেকোনো রাষ্ট্রের মতোই এখন ইনফরমেশন টেকনোলজির আওতায় যুক্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা ডিজিটাল জীবনযাপনে অনিবার্যভাবেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিংবা বলা চলে বাধ্যও হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এখন সচেতনতা এখন অনেক তুঙ্গে। অনেকেই আছেন লেখাপড়ায় আগ্রহী, চাকরি পাওয়ার জন্য উন্মুখ। দেশ গড়তে চায় সবাই। দেশাত্মবোধও আছে চরমভাবে। বিশাল জনশক্তি দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে চায়। প্রতিযোগিতায় দেশকে ঊর্ধ্বে দেখতে চায়, দুর্নীতিমুক্ত-স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ চায়। এমন একটি দেশের তারা স্বপ্ন দেখে যে দেশে মানুষ সুস্থভাবে নিরাপত্তার সঙ্গে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। দেশের অনেক মেধাবী মানুষ আছেন তারা মেধা বা যোগ্যতা বলে বিদেশে ভালো কাজ করছেন, দেশের হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছেন। দেশকে নিয়ে গর্বও বোধ করেন তারা। কিন্তু দেশের মুক্তির স্বপ্নও তো তা-ই ছিল। স্বাধীনতার পর গত কয়েক দশক আমরা শুধু স্বপ্নই দেখে চলেছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কিছু অর্জন করতে পারিনি। যে উন্নতি ও উত্থান আমরা দেখতে পাই তা স্বীয় উদ্যোগে, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। করপোরেট বাণিজ্য বা পুঁজিবিশ্ব গোটা অঞ্চলকে দখল করেছে। এবং এমনটা ঘটবে তার আর বিচিত্র কি? সবকিছুই তো উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। উপযোগিতা থেকেই মানুষ তার ক্ষেত্রকে বেছে নেয়। কর্মচাঞ্চল্যের প্রবাহও তার সঙ্গে যুক্ত। বিপুল জনশক্তির বাজার যে ধরতে পারবে, সে-ই প্রতিষ্ঠা পাবে। মানবিক মূল্যবোধগুলো সেভাবেই আটকে গেছে, থমকে গেছে বিশেষ আবর্তে। চিন্তার স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যও কমে গেছে। অনতিক্রান্ত বৃত্তেই ঘোরাফেরা করছে সবকিছু। একদিকে বিপুল পরিমাণে চলছে ভোগবাদের উল্ল­াস, অপরদিকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-ত্রাস-নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। পুঁজিবাজারে মানুষের বৈষম্য কমছে না। বৈষম্য থেকে ক্ষোভ-ক্রোধ-উষ্মা বাড়ছে। বৈধতার বদলে অবৈধ চিন্তা বাড়ছে, নিজের স্বার্থ কিংবা নিজের আখেরে লাভ সবাই হিসাব গুনছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব নির্বিশেষে মোহে আচ্ছন্ন। জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা অপ্রতুল। ইহলৌকিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের মনগড়া আখ্যা আর ব্যাখ্যানে জীবনের অর্থ সমাপন করছে। অথচ কি দুর্দৈব! সে মানুষ আবার বিপুল ও প্রচণ্ডভাবে ধর্মভীরু, অবৈজ্ঞানিক। এমনটা এখন সত্যে প্রতিষ্ঠিত, যে বেশি ধর্মভীরু সে তত বেশি লোভী ও ভোগবাদী-স্বার্থনিষ্ঠ। মানবিক মূল্যবোধের চাইতে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে যে ইহলৌকিক জীবনাচারে ব্যস্ত সেখানে নিজের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্তির লোভ ছাড়া কিছু করতে পারছে না। একদিকে ল্যাপটপ ব্যবহার করছে, দামি গাড়িতে উঠছে, বিদেশ ভ্রমণ করছে; অন্যদিকে ভদ্রবেশ ধারণ করে নির্বিচারে দুর্নীতি আর লোভ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হচ্ছে। ভেবেই নিচ্ছে যে পাপী-গোনাহ্গারদের জন্য ক্ষমা তো অনিবার্য। পাপে যেহেতু ক্ষমার বিধান আছে সুতরাং ‘পাপে’ অশান্তি থাকবে কেন! এভাবে আমাদের সমাজে লেজেগোবরে একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পণ্যবৃত্তির অবাধ প্রসার চলছে। মিডিয়ায় অসংস্কৃত উদ্দামতা কার না চোখে পড়ছে? কীভাবে তারকা হওয়া যায়, খুব সস্তা শ্রমে বিত্তের মালিক হওয়া যায়, প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়— তা সে যে মানেরই হোক, আদায়ের ওষুধ কোথায় তা খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত। যে নায়িকা নাচেন তিনি অভিনয় করেন, বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নেন, উপস্থাপনার কাজ করেন, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইন্টারভিউ নেন— সবকিছুই তার কাছে সোজা ও স্বাভাবিক। নিজে জেনে যান যে তিনি খুব মেধাবী! লেখালেখির জগতেও খুব তাড়াতাড়ি একজন লেখক অলেখক আর অলেখক লেখক বনে যান। সম্পর্ক আর যোগাযোগই যেন সবকিছুর মানদণ্ড। একবার জনপ্রিয় হলে তো আর কথাই নেই; কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসবে মিডিয়ায় উল্ল­­­ম্ফন আসবে এ আর কম কী! এটাই এখন জীবনের মোক্ষ। অথচ যিনি লেখক হতে চান বা কবি হতে চান তার সাধনা কেমন হওয়া উচিত, কতটা মেধাবী হওয়া উচিত, কতটা চর্চায় থাকা উচিত— তা কে না জানেন? ত্যাগ-সহিষ্ণুতা-ধৈর্য-চর্চা-অর্জন-অধ্যবসায় এসব আজ বেনোজলে গেছে ভেসে। সবকিছু শুষে নিয়েছে পুঁজি। পুঁজি পেতে যা লাগে তাতে নারী-পুরুষ, প্রণয়-প্রেয়সী-ক্লায়েন্ট সবাই সন্তুষ্ট। এই সন্তুষ্টির জন্য যা করা দরকার তা-ই করছে। এভাবে অসততা, অদক্ষতা, অগভীরতা, বৈচিত্র্যহীনতা তুমুুলভাবে বাড়ছে। কোয়ালিটি হারিয়ে যাচ্ছে। মুনাফা করতে গিয়ে যে কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয় নিতে আমরা পিছুপা হই না। সেখানে মূল্যবোধ-সূক্ষ্মতা কোনোভাবেই গুরুত্ব পায় না। এতে করে জন্ম নেওয়া অবিশ্বাস ও অস্বস্তি থেকে জীবনের স্পন্দনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নে বাংলাদেশ বাধা পড়ছে পুঁজি ও প্রতিক্রিয়ার কোপানলে। এগুনোর বদলে পড়ছে পিছিয়ে। বলতে দোষ নেই তাতে করেই মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদ আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

গরিব মেধাবী ছাত্রদের অর্থলিপ্সা বা মাসোহারা দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় মৌলবাদী সংগঠন তাদের সেন্টিমেন্টকে নিজের করে নিচ্ছে। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, হাসপাতাল, গালফ স্টেটের ব্যাংক, বিভিন্ন মেয়াদি চাঁদাবাজির মাধ্যমে তাদের কোটি কোটি টাকার ফান্ডে লেখাপড়ার নামে প্রশিক্ষিত হচ্ছে গরিব মেধাবী ছাত্ররা। তারা দীক্ষা নেয় ‘গাজী’ বা ‘শহীদ’ হওয়ার। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে গত সাতচল্লিশ বছরে বেড়েছে এবং এখনো বেড়ে চলেছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বপ্ন এক ‘কাগুজে বাঘ’ রূপে পরিগণিত হয়েছে তাতে আর সন্দেহ কি? আমাদের একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তরতাজা স্বপ্ন যেমন আছে, তেমনি নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ বিচিত্রভাবে ভোগবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আছে। আর এ ভোগবাদের হাত ধরেই ঢুকে পড়েছে বিচিত্রমাফিক ফ্যানাটিক, অযৌক্তিক, মোহান্ধ কর্মকাণ্ডগুলো, যা দেশের সম্মুখবর্তী হওয়ার পথ করে তুলেছে অবরুদ্ধ। আর দুর্ভাগ্য হলেও এমনটা সত্য, ইতিহাস না জানা বা ইতিহাস-বিরোধী একটি অসংস্কৃত ভোগবাদী ধারা নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠছে। তারা গত সময়গুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মানুষকে বোঝাতেও সক্ষম হয়েছে অযৌক্তিক ও কূপমণ্ডূক যুক্তিগুলো। কারণ ধর্মভীরু ও দরিদ্র-সরল মানুষকে ভারতবিরোধিতার কথা বলেও ভোট নেওয়া সম্ভব। এগুলোর মাত্রামান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু সাধারণত ভুল বলে প্রতিপন্ন হওয়ার কিছু নেই।

আমরা বলতে চাই কীভাবে মুক্তিসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতগুলো রচিত হয়েছিল, কীভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে অস্বীকার করে বাঙালি মুসলমান তার আত্মপরিচয়কে চিনে নিয়েছিল, জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হলো; কিংবা তার পরের ইতিহাস কত মর্মন্তুদ ও ঘোলা জলের ডোবায় নিপতিত হলো। রাষ্ট্রদ্রষ্টাকে সমূলে উৎপাটন করার অপচেষ্টায় আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ‘আইয়ুবি শাসনকাল’। ফলে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের স্তম্ভগুলো নিয়ে বিতর্ক ও বিপক্ষের জ্ঞানপাপ গৃহীত হলো। তখন সেখানে ঢুকে পড়ে স্বার্থান্ধরা, গণতন্ত্রের ধ্বংসকারীরা। ফলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বিচারে অগণতান্ত্রিক অপশক্তি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে। বৃথা বিতর্ক জুড়ে দিয়ে কোমলমতি মানুষকে নিয়ে শুরু হয় অপ-রাজনীতি। অবরুদ্ধ করে ফেলা হয় মুক্তবুদ্ধি ও জ্ঞানের-চিন্তার নিরন্তর চর্চারেখা। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেভাবে পৃথিবীর সব দেশে গর্বিত স্বাধীনতার বার্তা প্রচারিত হয়, জাতীয় ইস্যুগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছায় সেই আগুন ছড়িয়ে দিতে হবে সবার প্রাণে। জাতিকে মুক্তির স্বাদে করে তুলতে হবে উৎসবমুখর। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ করে তুলে জাতির গর্বিত সন্তান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আজ বিভ্রান্তির অমানিশা কেটে গেছে, সময় এসেছে প্রকৃত সত্যে ও ইতিহাসে পৌঁছানোর। প্রগতির চাকা আর পেছনে নয়, সম্মুখের দিকে চালাতে হবে। যে স্বপ্ন নিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা তা প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। এটি ডিজিটাল যুগ, দ্রুততর সুবিধায় অনেক কিছু অর্জন করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু আমরা সে জন্য প্রস্তুত তো?

অনেক কিছুই তো খণ্ড-বিখণ্ড ছিল— সে সব দায়মুক্তি ও সত্য উন্মোচনের কৌতূহল তো এখন তৈরি হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই অতিশয়োক্তি বা আতিশয্য নয়, যা কখনো কখনো যেন আমাদের ভয় পাইয়ে দেয়। স্তাবকের দল আবার কিছু করে না ফেলে। আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়! সে বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। কারণ মাত্রামাফিক পরিমাণ-নির্ধারণই সবার কাম্য।

সত্য-মিথ্যা, নতুন-পুরনোতে অনেক কথাই চলে। কিন্তু আমরা যে শ্রেষ্ঠত্ব চাই এবং এ বিশ্বে শ্রদ্ধাসম্ভূত জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই— সেটি তো আর বলার অবকাশ নেই! কাজে-কর্মগুণেই আমাদের তা প্রমাণ করতে হবে। প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। উপরে যা বলেছি, তার পূর্বাপর ইতিহাস ও সচেতন অভিমুখগুলো চিনে নেওয়ার প্রয়োজনও এখনই— যদিও তা অনেকেই জানেন অধিক পুনরাবৃত্তির কারণে। তবে উপলব্ধিতে আনতে হবে। সবকিছু পেরিয়ে আমাদের চলার পথ তো আমাদেরই রচনা করতে হবে— তার কোনো বিকল্প আছে কি!

শহীদ ইকবাল

প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

   

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads