• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
জলজট জনজট যানজটের নগরী ঢাকা

প্রায়ই দেখি যাত্রীসমেত রিকশা উপুড় হয়ে পড়ে জলে গড়াগড়ি খেতে

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

জলজট জনজট যানজটের নগরী ঢাকা

  • প্রকাশিত ২৩ মে ২০১৮

রাজধানী ঢাকা শহর ইতোমধ্যে চারশ’ বছর অতিক্রম করেছে। অসংখ্য ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এ শহরটিকে ঘিরে রয়েছে চারটি বহমান নদী। নদীগুলো যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা, ইছামতী, বালু ও তুরাগ। ঘিরে থাকা চারটি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। বিশ্বের খুব কম শহরই আছে এমন নদী পরিবেষ্টিত। এ নদীগুলোর সঙ্গে ঢাকাবাসীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অনেকটা হরিহর আত্মার মতো। অপরদিকে বহমান নদীগুলোকে জাগ্রত করে রেখেছিল অসংখ্য খাল-নালা। এরকম প্রায় ৪৩টি ছোট-বড় খাল একসময় ঢাকা শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। অতিবৃষ্টিতে তখন শহরবাসীকে নাকাল হতে হয়নি। অনবরত ভারী বর্ষণও মহানগরীকে জলাবদ্ধতায় কাবু করতে পারেনি। খালগুলোর বদৌলতে জল মুহূর্তেই চারপাশের নদীগুলোতে গড়িয়ে পড়ছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় এটি; সেই সুসময় এখন আর নেই। নেই যেমনি খালগুলো, তেমনি নেই আধুনিক শহরের উপযোগী পরিকল্পিত সুয়ারেজ বা ড্রেনেজ ব্যবস্থাও। পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই জল নিষ্কাশন লাইন ও বক্স কালভার্ট। তা ছাড়া বর্ষাকালীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টি তো রয়েছেই। এতে করে ভারী বর্ষণ ঘটলেই মহানগরীর পিচঢালা সড়কগুলো জলে টইটম্বুর হয়ে পড়ে। দু-চার প্রজাতির মাছের আগমনও ঘটে তখন। জলজটের কারণে ওই সময় আর শহরবাসীর ভোগান্তির শেষ থাকে না। রিকশা কিংবা যন্ত্রযানের গতি থামিয়ে দেয় অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা। কর্মব্যস্ত মানুষকে তখন পড়তে হয় চরম বিপাকে। গাড়ির ইঞ্জিন বিগড়ে যাওয়ার ফলে সর্বসাধারণকে আরো দুর্গতি পোহাতে হয়। বেড়ে যায় এ সময় রিকশাভাড়াটাও। অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে গিয়ে কর্মজীবীদের অনেকখানি বেকায়দায় পড়তে হয় তখন। সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছতে না পেরে কর্তৃপক্ষের তপ্ত বাক্যবাণও হজম করতে হয়। এ সমস্যা শুধু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভারী বর্ষণের চিত্রই নয়- এটি রাজধানীর প্রতিটি সময়ের অতি বর্ষণের চিত্র। এ ধরনের ভোগান্তির চিত্রে আমরা প্রায়ই দেখি যাত্রীসমেত রিকশা উপুড় হয়ে পড়ে জলে গড়াগড়ি খেতে। নারী যাত্রীদের ক্ষেত্রে এ দুর্ভোগের চিত্র বড়ই করুণভাবে ফুটে ওঠে তখন। সেসব চিত্র পরিলক্ষিত হলে পরে মানবিক বোধে যেমন আঁচড় লাগে, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে আমরা অনেকটাই হেয় প্রতিপন্ন হয়ে পড়ি। কারণ বিশ্বের আর কোথাও সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানী শহরকে জলাশয়ে রূপান্তরিত হতে দেখা যায় না এবং এভাবে জলে গড়াগড়ি খেতে হয় না নগরবাসীকে। এর মূল কারণই হচ্ছে বিশ্বের প্রসিদ্ধ নগরীগুলো পরিকল্পিতভাবেই গড়ে উঠেছে, ফলে অতি বর্ষণে তাদের শহর জলাভূমিতে রূপান্তরিত হয় না। দূরদর্শী পরিকল্পনার সুবাদে তারা আধুনিক শহরের স্বাদ উপভোগ করছেন। অথচ মাস্টারপ্ল্যান যথাযথভাবে অনুসরণ না করাতে আমরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সুফল ভোগ করা তো হচ্ছেই না বরং রাজধানী শহরটা ক্রমান্বয়ে বস্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটু উদ্যোগী হলে নগরবাসীকে জলজট থেকে কিছুটা রেহাই দিতে পারেন কর্তৃপক্ষ। প্রথমত : পয়ঃনিষ্কাশন বা ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করে। দ্বিতীয়ত : রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে ভালোমতো খনন করে জলপ্রবাহের গতি বাড়িয়ে। তৃতীয়ত : বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ বন্ধ রেখে। নিদেন পক্ষে এ তিনটি কাজের ওপর জোর দিতে না পারলে নগরবাসীকে কোনোক্রমেই জলজট থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ একটি লেখায় মন্তব্য করেন, উন্নতবিশ্বের কোনো পর্যটক যখন ঢাকা শহরে আসার প্রস্তুতি নেন তখন তার দেশের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ বলে দেন, ‘যেখানে যাচ্ছ সেখানে ধুলা-বালি, মশা আর বিশ্রী গরম। এক কথায় নরকের মতো একটা জায়গায় যাচ্ছ।’ দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঢাকা শহরের এ ধরনের নেতিবাচক পরিচিতি মিলছে বিশ্ববাসীর কাছে। ইদানীং পরিচিতি মিলছে জলজট, জনজট ও যানজটের নগরী হিসেবে। যানজট, জনজট থেকে সহজে মুক্তি মেলার সম্ভাবনাও আমরা দেখছি না। কারণ, এ দুটি জট ইতোমধ্যে মহামারী আকারে রূপ নিয়েছে মহানগরীতে। প্রতিবছর রাজধানীতে দশ শতাংশ হারে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে রাজপথ অচল করে দিচ্ছে। যন্ত্রযানের পাশাপাশি যোগ হচ্ছে রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি। বলে রাখা ভালো, বিশ্বের আর কোনো রাজধানী শহরে যন্ত্রযানের সঙ্গে অযান্ত্রিক যানবাহন যোগ হয়ে নগরবাসীর জীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়নি। দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়নি জনজটেও। এ ছোট্ট শহরে যেমন পাল্লা দিয়ে মানুষ বাড়ছে তেমন আর বিশ্বের কোথাও নজরে পড়ছে না। ঢাকা শহরকে ইতোমধ্যে প্রায় দুই কোটি মানুষের পদভার বহন করতে হচ্ছে। বছরের পর বছর এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। তার ওপরে যোগ হচ্ছে ভিক্ষুকের উপদ্রব। এভাবে মানুষ শহরমুখী হতে থাকলে আগামী বছর দশেকের মধ্যে জনসংখ্যা কতটা বাড়তে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ শহর এমনিই বড় বড় ভবনের ভারে ন্যুব্জ। শিল্প-কারখানার বিষয়টি তো রয়েছেই। তার ওপর অধিক জনসংখ্যার চাপে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা বিরাজ করছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে না পারলে মহানগরীটিকে বাঁচিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়বে এবং বিশ্বের কাছে আমরা আরো হেয় প্রতিপন্ন হয়ে পড়ব। তাই সময় থাকতে এক্ষুনি নগর পরিকল্পনায় এগিয়ে আসতে হবে নগর কর্তৃপক্ষকে।

আলম শাইন

কথাসাহিত্যিক, বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষক ও পরিবেশবাদী

alamshine@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads