• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
মিয়ানমারে বীভৎস গণহত্যা

মিয়ানমারে সংখ্যালঘু নিপীড়ন মানবাধিকার লঙ্ঘন নামে কুলাবে না

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

মিয়ানমারে বীভৎস গণহত্যা

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৪ মে ২০১৮

কত যে বীভৎস তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মিয়ানমারে। সেখানে হয় রীতিমতো গণহত্যা। রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। চলে নারী ধর্ষণ, শিশুহত্যা। সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়; বলা হয় জ্বালাও এবং মারো, গুলিতে না মরলে জবাই করো। অনুচ্চারিত অনুমোদন নয়, নির্দেশই রয়েছে ধর্ষণের। সংখ্যালঘু নিপীড়ন মানবাধিকার লঙ্ঘন নামে কুলাবে না, ঘটনা নির্লজ্জ ও নির্জলা গণহত্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

এই গণহত্যা যে পুরোপুরি বর্ণবাদী, তাতেও কোনো সন্দেহ করার সুযোগ আগেও ছিল না, এখন তো একেবারেই নেই। মিয়ানমারের বর্মিরা ঐতিহাসিকভাবেই বর্ণবাদী। প্রমাণ আছে যে নিজেদের তারা শ্বেতাঙ্গ বলে ভাবতে পছন্দ করে এবং ভারতীয়দের কৃষ্ণাঙ্গ মনে করে থাকে। ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে, তখন থেকেই ভারতীয়রা বার্মায় গেছে, বিপুল সংখ্যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, শ্রমের বাজার— সর্বত্রই তারা উপস্থিত ছিল। বাঙালিরাও গেছে। বাঙালিরা তো সবচেয়ে নিকট-প্রতিবেশী। বর্ণবাদ ভারতীয় বিতাড়ন তখন থেকেই সমানে চলেছে। ১৯৩০ ও ১৯৬০-এর দশকে তা ঘটেছে ব্যাপক হারে। কেবল যে রোহিঙ্গারা তা নয়, ভারতীয়রাও বিতাড়িত হয়েছে। বর্ণবাদী বার্মিজ শাসকরা এখন পুঁজিবাদী হয়েছে। তারা ঠিক করেছে মিয়ানমারে একজন রোহিঙ্গাও রাখবে না। যুগ যুগ ধরে যে রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করছে, তাদের মেরে-ধরে তাড়িয়ে সে জায়গায় নিজেরা বসে যাবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার আগেই কেড়ে নিয়েছিল, এখন শেকড়সহ উপড়ে ফেলার মিশনে নেমেছে।

প্রচার করার চেষ্টা চলছে রোহিঙ্গারা দুষ্কৃতিকারী। দুষ্কৃতিকারী আমরাও ছিলাম। একাত্তরে। ওই নাম দিয়ে আমাদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আমরাও ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম প্রতিবেশী ভারতে, রোহিঙ্গারা যেমন আশ্রয় খুঁজছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। এরা অনুপ্রবেশকারী নয়, শরণার্থী। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে তারা মুসলমান বলে নয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অমুসলিমও আছে; হত্যা করা হচ্ছে তারা দুর্বল জাতিসত্তার মানুষ বলে। অমুসলিম রোহিঙ্গারাও প্রাণ হারিয়েছে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। তাড়িয়ে দেওয়া হবে; তাদের জায়গা-জমি; ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘর সংখ্যাগরিষ্ঠরা দখল করে নেবে। রোহিঙ্গারা যাতে ফিরে না আসতে পারে তার জন্য মাইন পোঁতা হয়েছে সীমান্তে। পরিকল্পনা আরো বিস্তৃত ও গভীর। রোহিঙ্গাদের খালি-করে-দেওয়া জায়গায় শিল্প এলাকা গড়ে তোলা হবে। সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ ঘটবে। বিনিয়োগের জন্য ডাকা হচ্ছে চীন ও ভারতকে, বাংলাদেশের পুঁজিওয়ালারাও যেতে পারেন ইচ্ছা করলে। চীন আর এখন আগের চীন নেই। নেই যে তার প্রমাণ আমরা একাত্তরে কিছুটা পেয়েছি, এখন খুব ভালোভাবে পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। পুঁজিবাদী-জাতীয়তাবাদী চীন এখন বিপুল হারে বিনিয়োগ করেছে মিয়ানমারে, আরো করবে আশা রাখে। রোহিঙ্গাদের বাঁচা-মরায় চীনের কিছু যায় আসে না। তার স্থির দৃষ্টি মুনাফার দিকে। রোহিঙ্গাদের আরেক প্রতিবেশী ভারত। ভারতের সঙ্গে চীনের এখন বেশ ভালো রকমের শত্রুতা, যুদ্ধ বাধে বাধে ভাব; কিন্তু ভারতও সমান আগ্রহী মিয়ানমারে বিনিয়োগের ব্যাপারে। রাশিয়াও অস্ত্র বিলি করে মিয়ানমারে। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায়ও মিয়ানমারকে সে কাছে টানতে চায়। মিয়ানমারের গণহত্যায় তাদের বিরোধিতা নেই। শেয়ালরা সব এক হয়েছে, মাংসের গন্ধ পেয়ে।

সবচেয়ে বেশি বিপদ শিশুদেরই। শরণার্থী হয়ে যারা এসেছে, তাদের শতকরা ৬০ জনই শিশু। এদের অনেকেরই পিতারা হারিয়ে গেছেন, মাতারা ধর্ষিত হয়েছেন, মারাও গেছেন। বহু শিশুরই অভিভাবক নেই। ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে। ছোট শিশুটি এসেছে বড় শিশুটির হাত ধরে। কিছুদিন আগে ভূমধ্যসাগরের কূলে একটি শরণার্থী কুর্দি শিশু বালুকাবেলায় পড়ে মারা গেছে; তার মর্মান্তিক ছবি সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তৈরি করেছিল। ওই রকমের ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তেও ঘটেছে। একটি শিশুর ছবি দেখেছি আমরা। মায়ের কোলে। জীবিত নয়, মৃত। ৪০ দিন বয়সের বস্ত্রহীন মৃত শিশুটি মায়ের কোলেই মারা গেছে। নৌকায় করে আসছিল। প্রায় তীরে এসে পৌঁছেছে, কয়েক গজ মাত্র বাকি, নৌকাটি তখন ডুবে যায়। শিশুটি মারা গেছে। মা যে কাঁদবেন তারও সময় নেই। আপনজন কেউ আসতে পেরেছেন কি-না মা’কে সেটা খুঁজতে হচ্ছে। শরণার্থী অসংখ্য শিশু অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে, ছবিতে দেখছি, আমরা। ক’জনের দিকে তাকাব? একটি ছাপিয়ে ওঠে অন্যদিকে।

ওদিকে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, মানবাধিকারের অতন্দ্র প্রহরী, শান্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার কারণে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত অং সান সু চি দাঁড়িয়ে গেছেন তার সরকারের লেলিয়ে-দেওয়া গণহত্যাকারী ও ধর্ষকদের পক্ষে। চুপ করে ছিলেন প্রথমে। সেও ভালো ছিল, এখন যেভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, তাতে হতবাক হয়ে গেছে বিশ্বের মানুষ। নরেন্দ্র মোদির কথা আলাদা, তিনি স্বঘোষিত বর্ণবাদী। তার দলের লোকেরাই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে; তিনি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এবং মিয়ানমারের শাসকদের পক্ষে দাঁড়াবেন এটা স্বাভাবিক; কিন্তু অং সান সু চি? আসলে সু চি’ও তো একজন পুঁজিবাদীই; তার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুবিধাভোগকারীদের জন্য, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য নয়। তিনিও সুবিধাভোগীদের দলেরই। থাকবেনও। তবে তাকে যারা নোবেল পুরস্কার দিয়েছেন, তারাও মনে হয় কিছুটা বিব্রত হয়েছেন। বলছেন, পুরস্কার যে ফেরত নেবেন সেটা সম্ভব নয়।

সু চি’র নির্মমতায় শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটু লজ্জা পেয়েছেন। বলছেন, ভগ্নি, আপনি মানবিক হোন। টুটুর কাছে বিরোধটা বৌদ্ধ ও মুসলমানদের নয়, প্রবল ও দুর্বলের। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। বলছে হত্যা ও ধর্ষণ বৌদ্ধধর্মীদের কাজ নয়, বৌদ্ধধর্মবিরোধী বটে। তিব্বতের গৃহহীন বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বলেছেন, মিয়ানমার সরকার যা করছে তা বৌদ্ধধর্মবিরোধী। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিবাদ করেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা মানববন্ধন করেছে। এসব স্বাভাবিক। নোবেল-বিজয়ী কিশোরী মালালা ইউসুফ জাইও পীড়িত বোধ করেছে এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আওয়াজও শোনা গেছে; প্রত্যাশিত ছিল যে তিনি আরো জোরে বলবেন, বিশ্ববাসীকে জানাবেন কী ঘটছে। যেমনভাবে সামাজিক ব্যবসার গুণাগুণ বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন, তার চেয়েও জোরেশোরে মিয়ানমারের গণহত্যার কথা বলবেন। সেটা তিনি করেননি। আসলে গরিবের যত বড় বন্ধুই হোন না কেন, তিনিও তো পুঁজিপন্থিই; ব্যবসার ব্যাপারটা ভালো বোঝেন, মুক্তির ব্যাপারটা বোঝেন না। মিয়ানমারের বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তার উপসংহারে তিনি বলেছেন, ‘অং সান সু চি নিশ্চয়ই এমন একটি নতুন মিয়ানমার গড়ে তুলতে চান, যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। জাতিগত, ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক কিন্তু শ্রেণি? তার ধারণা অভ্রান্ত, সব বৈষম্য নির্মূল করা হবে শ্রেণিবৈষম্য বাদে। এ চিন্তা উভয় নোবেল বিজয়ীরই। তারা শ্রেণিবৈষম্যের বিপক্ষে নন।

প্রশ্ন থাকে, মিয়ানমারে কি মানুষ নেই? তারা দেখছেন না? হয়তো আছে; একাত্তরে যেমন পাকিস্তানে ছিল, কিন্তু স্বৈরশাসনের হাতে তাদের গলায় জোর নেই। মিয়ানমারে একসময় ভয়াবহ সামরিক শাসন ছিল, সু চি ছিলেন তাদের শাসনে নির্যাতিত; এখন নির্বাচিত গণতন্ত্র এসেছে, ক্ষমতা সু চি’র হাতে। রোহিঙ্গারা সামরিক শাসনেও নির্যাতিত হয়েছে, কিন্তু এখন যেভাবে হচ্ছে, সেটা কল্পনাতীত। সুযোগ পেলে নির্বাচিত ‘গণতন্ত্রীরা’ও যে স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের ছাড়িয়ে যেতে পারে, সু চি সরকার তারই প্রমাণ। পুঁজিবাদী বিশ্বের সরকারগুলো সু চি’র পক্ষে থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। ঘটছে সেটাই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads