• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
এ কোন নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছি আমরা

ইন্টারনেট

মতামত

এ কোন নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছি আমরা

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ২৪ মে ২০১৮

সন্ধ্যার পরে আমার ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে প্রায়ই হাঁটতে বের হই। রাস্তার দু’পাশে ফলের দোকান। আমার ছেলের পছন্দের ফল আম। অথচ আম কিনতে ভয় পাই। ওর ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে ফলের দোকানগুলো এড়িয়ে চলি। এরই মধ্যে দৈনিক পত্রিকার একটি খবরে চোখ আটকে গেল। ১৯ মে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহ্বান জানিয়েছেন ‘আগামী এক সপ্তাহ আম কিনবেন না’। কারণ এদিন রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরে বেড়িবাঁধ এলাকায় ৮ থেকে ১০টি ফলের আড়তে অভিযান চালিয়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে পাকানো অপরিপক্ব ১২শ’ মণ আম জব্দ করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর ২১ মে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মাত্র চার দিনে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত নষ্ট করেছে ২ হাজার ৭২১ মণ আম।

মুসলমানদের কাছে পবিত্র মাস রমজান। এ মাসে মানুষ বেশি বেশি আমল করার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে। অথচ এ মাসেই খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের ব্যবহার বাড়ে বেশি। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বলছে, ‘ইফতারির শরবত, খেজুর থেকে শুরু করে সাহরির দুধ-কলা, মাছ কোনো কিছুই ভেজালমুক্ত না। ইফতারির প্রতিটি খাদ্যপণ্যেই ভেজালের বিষ।’ একদিকে যেমন নোংরা পরিবেশ তেমনি কেমিক্যাল মেশানো খাদ্যপণ্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষ মারার উপাদান। মুড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া সার, বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। জিলাপিতে গাড়িতে ব্যবহূত পোড়া মবিল, বাসন্তী রঙ। হাতে তৈরি খাবারই শুধু নয়, প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ফল, শাকসবজিতেও মেশানো হচ্ছে ফরমালিনসহ নানা রাসায়নিক দ্রব্য। রঙিন খাবারে দেওয়া হচ্ছে টেক্সটাইলে ব্যবহূত কেমিক্যাল রঙ।

আমাদের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অত্যাধুনিক পরীক্ষাগারে আম, আনারস, আপেল, কলা, গাজর, টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুসপাতা, তরল দুধ, কোমলপানীয়, বোতলজাত জুস, শুঁটকি মাছসহ আরো কিছু খাদ্যপণ্যের একাধিকবার নমুনা পরীক্ষায় ভয়ানক বিষাক্ত রাসায়নিক এলড্রিন, মিথাইল প্যারাথিয়া, আলফা ক্লোডিন, ডিডিটিই, ইথিওন, হেপ্টাক্লোর ও ডেল্টা-বিএইচই পাওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের কাছে ফরমালিন নাকি তেমন কিছুই না। কারণ ফলমালিনের চেয়েও শতগুণ বেশি ক্ষতিকারক ডিডিটিই, এলড্রিন, মিথাইল প্যারাথিয়া, আলফা ক্লোডিনের মতো রাসায়নিক। দেশের ২৮৭টি বৈধ পানির বোতলজাত কারখানা থাকলেও বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বোতলজাত পানিতেও নাকি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মান রক্ষা করা হয়নি। এসব পানি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ‘অতি নিম্নমানের পানি’ হিসেবে চিহ্নিত। অথচ পানিকে বলা হয় জীবন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য। সবাই তার খাদ্যকে নিরাপদ রাখে। খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে অনেক জটিল রোগ জন্ম নেয়। মাত্র একদশক আগেও ক্যানসার নামক মরণব্যাধি এত ব্যাপক আকারে আমাদের দেশে ছিল না। কালেভদ্রে শোনা যেত কারো ক্যানসার হয়েছে। আর এখন প্রায় সব ঘরে কোনো না কোনো ধরনের ক্যানসারের রোগী। মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট, হাসপাতালে ক্যানসার রোগীর অসহায় আর্তনাদ— আমাদের কিছুই করার নেই। ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বাড়ার কারণ খাদ্যে ভেজাল। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যা থাকে, তার কোনো কিছুই আজ ভেজাল মুক্ত না। সচেতনভাবে সামান্য একটু বেশি লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন এবং বাজারজাত করার সময় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভেজাল। শুধু তাই নয়, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকারণ ফরমালিনসহ নানারকম বিষাক্ত রাসায়নিক। যা থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানসারসহ নানা রোগব্যাধি। বাড়ছে কিডনি, হার্ট, ব্যথাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগীর সংখ্যা।

১৮৫৯ সালে বর্ণহীন, দুর্গন্ধযুক্ত একটি রাসায়নিক যৌগের অস্তিত্ব শনাক্ত করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের রসায়নবিদ আলেকজান্ডার বুতলারভ। পরবর্তীকালে এ রাসায়নিক যৌগটিকে ফরমালডিহাইড বা মিথান্যাল নামে চিহ্নিত করা হয়। দেখতে সাদা পাউডারের মতো পানিতে দ্রবীভূত ফরমালিন টেক্সটাইল শিল্প, প্লাস্টিক, পেপার, রঙ, কনস্ট্রাকশন এবং মৃতদেহ সংরক্ষণে ব্যবহূত হয়। এই যৌগটির প্রধান বৈশিষ্ট্য, এটি সংক্রমিত হতে দেয় না এবং পচন প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ধ্বংস করতে পারে। তবে উপকারী দিকের চেয়ে যৌগটির ক্ষতিকারক দিকই বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রামের গবেষণায় যৌগটিকে মানুষের শরীরে ক্যানসার রোগ সৃষ্টির জন্য সরাসরি দায়ী করা হয়। এ ছাড়া ফরমালিনের প্রভাবে অন্ধত্ব, পেটের পীড়া, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়। এ রাসায়নিক যৌগ ধীরে ধীরে মানবদেহের লিভার, কিডনি, হার্ট ও ব্রেইন ধ্বংস করে। এর প্রভাবে মানুষের স্মৃতিশক্তিও কমে যায়। ক্ষতিকারক নানা রকম দিক বিবেচনা করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফরমালিনসম্পৃক্ত জিনিসপত্র ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফরমালিনের ব্যবহার হয় পরীক্ষাগারে এবং শিল্পকারখানায়। কিন্তু পরীক্ষাগারের নিয়ন্ত্রিত কক্ষ ছেড়ে ফরমালিন ঠিক কবে বেরিয়ে পড়েছিল তার ইতিহাস জানা নেই। রুশ বিজ্ঞানী ফরমালিন আবিষ্কার করলেও তিনি হয়তো দুঃস্বপ্নের ভেতরেও ভাবতে পারেননি, দুশ’ বছর পেরিয়ে এ রাসায়নিক যৌগটি একটি জাতির ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হবে। এটা একটি জাতিকে ধ্বংস করতে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। ফরমালিন এখন আমাদের খাবারে। যেহেতু এটি পচন প্রক্রিয়াকে রোধ করে, তাই পচনশীল দ্রব্য যেন ভালো থাকে, লাভের অঙ্কে যেন টান না পড়ে, তাই ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে রাসায়নিকটি। তারা নিজেরাও জানেন, এর ক্ষতিকারক দিক, কিন্তু ক্ষতির চেয়ে তাদের লাভের অঙ্ক যেহেতু বড়, তাই জেনে-শুনে মানুষকে বিষ খাওয়াতে কৃপণতা নেই। এ বিষয়ে আইন আছে। পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৯ অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে ফরমালিনের ব্যবহার ও বিক্রি নিষিদ্ধ। ফরমালিনের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশও রয়েছে। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে খাদ্য নিরাপত্তার কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। এটাও ঠিক কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই— এ প্রবাদের মতোই। আইন মানার বালাই নেই কারো। ফরমালিনের দামও হাতের নাগালে। ১ কেজি ফরমালিনের দাম মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা। এ টাকা বিনিয়োগ করে যদি কয়েক হাজার টাকার পচনশীল দ্রব্য বাঁচানো যায়, তাহলে এর ব্যবহারে লোভের ছায়া তো পড়তে বাধ্য। এর প্রমাণ সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্যে জানা যায়, কয়েক বছর আগের একটি পরিসংখ্যানে জানা যায় আমাদের ১০০ টন ফরমালিনের প্রয়োজন থাকলেও আমদানি হয় ২৫০ টন। চাহিদার অতিরিক্ত ফরমালিন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে প্রবেশ করে আমাদের শরীরে। ফরমালিন আমদানির হার ফি বছর বাড়ছে। কারণ এর সহজলভ্য, সহজপ্রাপ্য এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। ফরমালিন আমদানির অনুমোদন নীতিমালাও বেশ নমনীয়। আমদানি লাইসেন্স ফিও হাতের নাগালে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমদানিতে সরকারি তহবিলে জমা দিতে হয় মাত্র দুই হাজার ১০০ টাকা। বাস্তব কারণেই ফরমালিন আমদানি নিষিদ্ধ সম্ভব নয়। এটা যুক্তিসঙ্গতও নয়। কারণ এর মূল যে ব্যবহার শিল্পকারখানা এবং পরীক্ষাগারে, তা সচল রাখতেই আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু ফরমালিনের ব্যবহার যেন যথাযথ হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। আমদানির পর ফরমালিন কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার।

গণমাধ্যমের কল্যাণে আজ সবার জানা ফরমালিনের ক্ষতিকারক দিক। মানুষকে সচেতন করতে ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধাপে রাজধানীর সাতটি কাঁচাবাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্য বাজারের তুলনায় সে সময় এসব বাজারে বিক্রি হওয়া পণ্যের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু সেই উদ্যোগেও ভাটা পড়েছে। আবার এসব বাজারে বিক্রি হওয়া খাদ্যদ্রব্যেও দশমিক ৯৯ পিপিএম পর্যন্ত ফরমালিনের সন্ধানের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছিল। তা এটার পেছনে বলা হয়েছিল— এই মাত্রার ফরমালিন শরীরে সহনীয়। ফরমালিন যেহেতু বিষ। সেহেতু বিষের তো কোনো সহনীয় মাত্রা থাকতে পারে না। আমাদের ফুড অর্ডিন্যান্স স্পষ্ট বলছে, খাদ্যপণ্যে কোনো মাত্রার ফরমালিনই গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ সেই অর্ডিন্যান্সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের নিযুক্ত টেকনিশিয়ানরা খাদ্যপণ্যে ফরমালিনের মাত্রা ঠিক করে দিচ্ছে। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ!

খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার বন্ধে জনগণের সচেতনতা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের লোভ সংবরণ করা প্রয়োজন। ফরমালিন মেশানো খাবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও বাজার থেকে কেনেন, সেই খাবার তাদের সন্তানের মুখেও তুলে দিতে হয়। সরকার আইন তৈরি করেছে, কিন্তু তা প্রয়োগের দায়িত্ব যার বা যাদের ওপর, তারা যদি আন্তরিক না হন, একবারও ভাবেন না যে, তাদের সন্তানও এই নীরব বিষের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, তাহলে সর্ষের ভেতরের ভূতের আছর কোনো দিনই যাবে না। একইভাবে যেসব ব্যবসায়ী লোভে অতিরিক্ত লাভের আশায় ফরমালিন বা এ ধরনের ক্ষতিকারক রাসায়নিক খাবারে মেশায়, তারাও তো কোনো না কোনোভাবে সেই খাবার ঘরে নিয়ে যায়, তাদের সন্তানও তো সেই খাবার মুখে তোলে। তাই খাবারে ফরমালিন মেশানোর যে অচ্ছেদ্য চক্র, তা ছিন্ন করতে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে ব্যবসায়ীদেরই। তারা যদি নীতির পরিবর্তন করেন, তাহলেই ফরমালিনমুক্ত খাদ্যপণ্য পাওয়া সম্ভব। আমাদের শিশুখাদ্যের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। একদিকে যেমন অতিরিক্ত রেডিয়েশনের গুঁড়ো আসছে, অন্যদিকে শিশুদের পছন্দের মিষ্টিজাতীয় খাবারে মেশানো হচ্ছে সোডিয়াম সাইক্লাইমেটের মতো রাসায়নিক উপাদান। আমাদের লোভের মাত্রা এতো বেশি বেড়েছে যে শিশুখাদ্যের ব্যাপারে আমরা আরো কঠোর। তাই শিশুদের খাবারে কোনো ছাড় তো নয়ই, বরং আরো কতভাবে শিশুদের বিকলাঙ্গসহ পুরো জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়া যায় তারই মহোৎসব চলছে। অথচ একবারও আমরা ভাবি না, এই খাবার আমার সন্তানও কোনো না কোনোভাবে খেতে পারে। রেগে গেলে আমরা মানুষকে, প্রতিপক্ষকে কোনো না কোনো প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করতেই ভালোবাসি। কোনো না কোনো প্রাণীর সন্তানের নামে সম্বোধন করতে ভালোবাসি। কিন্তু কোনো প্রাণী কি পারে, নিজ হাতে তার সন্তানদের মেরে ফেলতে? কোন প্রাণী কি তার শিশুকে হত্যা করতে পারে, যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমরা হত্যার খেলায় মেতে উঠেছি? আমরা সবাই যদি নিজের নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবি, শুধু লাভের আশায় যে বিপজ্জনক পথে হাঁটছি, তা থেকে আমার সন্তানও বিপদের মুখে পড়ছে, তাহলেই হয়তো মুক্তির দেখা মিলবে।

লেখক : সাংবাদিক, কবি

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads