• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
তিস্তা চুক্তি কতদূর-এক

তিস্তা ব্যারেজ

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

তিস্তা চুক্তি কতদূর-এক

  • আতাহার খান
  • প্রকাশিত ২৫ মে ২০১৮

দুদিনের সফরে আজ ভারত যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসেবে বক্তব্য রাখবেন তিনি। এ অনুষ্ঠান শেষে যাবেন বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করতে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও উপস্থিত থাকবেন। পরে দুই দেশের সরকারপ্রধান আলোচনায় বসবেন। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, এটা আমরা আশা করতে পারি। এখানে আমাদের একটাই চাওয়া, এই আলোচনায় তিস্তা ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কারণ ৩৫ বছর ধরে অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছে। চুক্তি স্বাক্ষর হবে হবে করেও শেষপর্যন্ত হয়নি। কারণ পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি। তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেবেন না। তারপরও স্বীকার করে নিতে হবে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। তাই আমরা আশায় স্বপ্ন বেঁধে আছি একদিন না একদিন অবশ্যই হবে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার মীমাংসা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও তিস্তা সমস্যার সম্মানজনক সমাধান চায়। কারণ আছে অবশ্যই— সেটি হলো সামনে নির্বাচন। চলতি বছরেই একাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব হলে দেশবাসী তাকে বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই মনে করবে। তা ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল বাংলাদেশের শস্য ভান্ডার বলে খ্যাত। এই অঞ্চলটি পুরো তিস্তা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। চুক্তিটি হলে তিস্তা অববাহিকার তিন কোটি মানুষের কাছে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। তখন হয়তো অনেক সহজ হবে রংপুর বিভাগকে এইচ এম এরশাদের প্রভাববলয় থেকে বের করে নিয়ে আনা। এসব উদ্দেশ্য সামনে রেখেই নির্বাচনের আগে সরকার চায় তিস্তা ইস্যুর স্থায়ী মীমাংসা। এ ধরনের একটি ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে কিছুদিন আগে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, দুদেশই অন্তর্বর্তী চুক্তির খসড়া নিয়ে এগুচ্ছে। তারও আগে বলা হয়েছিল, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এই আশ্বাস দিয়েছিলেন সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি এও বলেছিলেন, শিগগির সমতা, ন্যায়ানুগতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করা হবে। জাতীয় সংসদে সরকারি দলের জনৈক সংসদ সদস্যের (মো. আবুল কালাম) এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেছিলেন। এই দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে সবকারের অবস্থান পরিষ্কার বোঝা যায়।

তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব রকমের চেষ্টাই অব্যাহত আছে। এইসব উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এজন্য যে এর সঙ্গে বাংলাদেশে তিস্তার প্লাবনভূমির ২৭৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মানুষের স্বার্থ জড়িত। বিষয়টি যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এসেছিলেন ঢাকায়— উদ্দেশ্য ছিল তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তার আপত্তির জন্য সে চুক্তি হয়নি। গত বছর এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিস্তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আসলে তিস্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনা সেই গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে অব্যাহতভাবে চলে আসছে। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে পানির হিস্যা নিয়ে যে আলোচনা হয় তাতে বাংলাদেশ মোট প্রবাহের ৩৬ শতাংশ পাবে আর ভারত পাবে ৩৯ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ থাকবে নদীর জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু সুস্পষ্ট নির্দেশনার অভাবে চুক্তিটিও শেষ অবধি থেকে যায় অমীমাংসিত। এরপর আবার ২০০৭ সালের ২৫ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত একটা যৌথ বৈঠক হয়— সেখানেও বাংলাদেশ দাবি করেছিল ৮০ শতাংশ পানি দুদেশ সমানভাবে ভাগ করে নেবে। বাকি ২০ শতাংশ পানি নদীর জন্য থাকবে সংরক্ষিত। এভাবেই এবং এপথ ধরেই দুদেশের মধ্যে চলতে থাকে আলোচনা। কিন্তু ভারত এরই মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে গজলডোবায় ১৯৮৭ সালে বিশাল এক বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এবং এই প্রকল্পের কাজ তারা ১৯৯৮ সালের মধ্যেই শেষ করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে কিছুই জানানো বা অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। বাঁধটা এত বড় যে এর মোট গেটের সংখ্যা ৪৫টি। মাত্র দুটি গেট ছাড়া বাকি ৪৩ গেটের মাধ্যমে তিস্তার প্রায় পুরো পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। সেই পানি তারা মহানন্দার ভিতর দিয়ে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, মালদহ, জলপাইগুড়িসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজে সেচের পানি হিসেবে সরবরাহ করছে। এমনকি বিহারের মেচি নদী পর্যন্ত এই পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

অভিন্ন নদীর পানি এরকম একতরফাভাবে প্রত্যাহার করার আইনগত অধিকার কি উজানের দেশের আছে? উজানের দেশ কি পারে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নদীনির্ভর পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতি করতে? সময় যত এগুচ্ছে ততই প্রশ্নগুলো বড় হয়ে উঠেছে। আজ বাংলাদেশকে অবশ্যই বুঝে নিতে হবে ভাটির দেশ হিসেবে তার নদীনির্ভর পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রাণিসম্পদ যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়— প্রয়োজন হলে বারবার তিস্তা ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিষয়টির পক্ষে উল্লিখিত দাবিগুলো তুলে ধরে বসতে হবে আলোচনার টেবিলে, স্থায়ী মীমাংসার প্রয়োজনে। তিস্তা অববাহিকায় বসবাসরত তিন কোটি মানুষের টিকে থাকবার স্বার্থে তিস্তার পানির ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। প্রয়োজনে দাবি করতে হবে ক্ষতিপূরণেরও। কারণ আন্তর্জাতিক নদীর পানি কীভাবে ব্যবহূত হবে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন সমিতি ১৯৬৬ সালে হেলসিংকি নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেই নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একে অন্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, অভিন্ন নদী যেসব দেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হবে সেসব অঞ্চলের প্রতিটি দেশই যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে লাভ করবে পানিসম্পদ ব্যবহারের অধিকার।

এ ছাড়া ১৯৯৭ সালে জলপ্রবাহ কনভেনশনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কিছু নীতিমালা গ্রহণ করে। সেই নীতিমালার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পানি ব্যবহারের কথা। এ ব্যাপারে পরিবেশবিষয়ক জীববৈচিত্র্য কনভেনশন আরো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে— সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব, উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এর কোনো নীতিমালাই ভারত মানেনি। আমরা জানি যে, তিস্তার পানি একতরফাভাবে সরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও নৌ-চলাচল মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা পুরো শুকিয়ে যায়। সেখানে পানিও থাকে না। চারদিকে ধু ধু বালি আর বালি। পানির অভাবটা তখন এতটাই বেড়ে যায়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চরম দুর্দশার সম্মুখীন হয় তিস্তা অববাহিকার সাধারণ মানুষ। তিস্তার ওপর নির্ভশীল এইসব মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার কোনো আইনগত অধিকার উজানের দেশের নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তিস্তা চুক্তি হবে হবে করেও সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে বছরের পর বছর। এর পেছনে কি এই উদ্দেশ্যই সক্রিয় ছিল যে গজলডোবা প্রকল্পের কাজটি সম্পন্ন করা? তা না হলে ১৯৮৩ সাল থেকে তিস্তার পানি বণ্টনের যে আলোচনা চলে আসছিল তার কোনো মীমাংসায় না পৌঁছেই ঠিক মাঝপথে, ১৫ বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের মধ্যেই এই বাঁধের কাজ সম্পন্ন করে ভারত! এবং আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবহিত না করেই পানি প্রত্যাহারের কাজ শুরু করে দেয় তারা। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে বছর বছর আলোচনা সচল রাখার কাজটি ছিল নিছক লোকদেখানো? হ্যাঁ, এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হবে ভারতকে।

 

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা

atahar2009@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads