• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
রাজনীতি ও সমাজলগ্ন নজরুলের অভিভাষণ

কাজী নজরুল ইসলাম

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

রাজনীতি ও সমাজলগ্ন নজরুলের অভিভাষণ

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ২৫ মে ২০১৮

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের গত শতাব্দীর এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের নাম। সত্য ও নির্ভীক এই কবির এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’। তাই তিনি যুগপৎ রচনা করে গেছেন প্রেমের সঙ্গীত এবং দ্রোহের কবিতা। আবার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত এই কবি সবসময় ছিলেন হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের প্রতি সহমর্মী। তাই তো কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল একাধারে শ্যামা সঙ্গীত ও ইসলামী গান রচনা করা। আজ তাই কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়েছেন।

বিশ শতকের শুরু থেকে মধ্য সময় পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন আর তার কূটচালে ছিন্ন হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং ছড়িয়ে দেওয়া হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিষবাষ্প। বাঙালির ঐক্যের ভিতরে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি বজায় রাখতে এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কবি বার বার ছুটে গিয়েছেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সমগ্র বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বিভিন্ন আয়োজনে, অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যে বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলো আজ কবির অভিভাষণ হিশেবে পরিচিত। সেসব অভিভাষণের ভিতরে এক মুক্তমনের স্বাধীনচেতা নজরুলের দেখা মেলে। আবার তাঁর ভিতরে সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান হীনমন্যতা, মানুষে-মানুষে যে হিংসা-দ্বেষ-শঠতা— তারও বহির্প্রকাশ ঘটেছে। মূলত এ অভিভাষণগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবিক বোধ।

নজরুলের অভিভাষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো যৌবনের গান। এটি বর্তমান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী কর্তৃক আয়োজিত মুসলিম যুব সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির বক্তব্য ছিল। এই বক্তৃতায় কবি নিজ সমাজ ও দেশে যা কিছু মঙ্গলকর, তার উদ্দেশ্যে লড়তে যুবসমাজকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার এই তারুণ্য একজন বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যেও থাকতে পারে, যদি তার মনের জোর থাকে। তাই কবি বলেছেন, ‘যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না।’ পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি, কবির এই বক্তৃতা কলকাতার দ্বিমাসিক সাম্যবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এমনই আরও একটি কবির উল্লেখযোগ্য অভিভাষণ তরুণের সাধনা। এটি ১৯৩২ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতি হিশেবে কবির প্রদত্ত ভাষণ। এখানে কবি গোঁড়া মুসলিমদের পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা, অন্ধ কুসংস্কার এবং ইসলামের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে সঠিক তথ্যকে আড়াল করে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। ফলে কোরআন-হাদিসের মূল সত্য থেকে দূরে রয়েছে এই মুসলমান সমাজ। আর এ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে প্রকৃত অর্থে ভারতবর্ষের মুসলমান জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। তাই কবি তাঁর বক্তব্যের শেষে বলেন, ‘আমরা চাই সিদ্দিকের সাচ্চাই, ওমরের শৌর্য ও মহানুভবতা, আলির জুলফিকার, হাসান-হোসেনের ত্যাগ ও সহনশীলতা। আমরা চাই খালেদ-মুসা-তারেকের তরবারি, বেলালের প্রেম। এই সব গুণ যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তবে জগতে যাহারা আজ অপরাজেয় তাহাদের সহিত আমাদের নামও সসম্মানে উচ্চারিত হইবে।’

কাজী নজরুল ইসলামের এসব অভিভাষণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের সমাজ-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতির এক চিত্ররূপ আমাদের সামনে উঠে আসে। এসবের মাধ্যমে কবি মূলত আপামর জনমানুষকে বিশেষত যুবসমাজের মধ্যে দেশ, জাতির সপক্ষে মুক্ত মানবতার মূলমন্ত্র প্রণোদনার মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আমরা দেখি যে, কবিকে যখন ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে বিপুল সমারোহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়, সেই তখনও কবি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মগ্ন, কুণ্ঠিত; দ্বিধান্বিত হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির আলগা বন্ধন দেখে; আবার সাহিত্য তার প্রকৃত লক্ষ্যে কতখানি এগোচ্ছে, সে বিষয়েও তিনি শঙ্কিত। কবিকে তাই বলতে হয়, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

কবির মাত্র ২২ বছরের সাহিত্য সাধনায় তাঁর এই অভিভাষণ কবির অসুস্থতার কিছু আগে প্রদত্ত। ফলে এ সময় কবিকে কী এক দূর লোকের মোহাচ্ছন্ন দার্শনিকতায় পেয়ে বসে। তিনি যেন বুঝে যান এই দেশ, এই সমাজ, এই জাতির মঙ্গল কামনায় তিনি যা চেয়েছেন, যেভাবে চেয়েছেন— বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তা যেন দূর প্রহেলিকা। তাই তো কবি তাঁর জীবনের শেষ অভিভাষণ ১৯৪১ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতির বক্তব্যে বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হূদয় নিয়ে বলেন, ‘যদি আর বাঁশি না বাজে আমি কবি বলে বলছিনে— আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি— আমায় ক্ষমা করবেন— আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি— আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম— সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ এরপর প্রকৃতই সারা জীবন মানবতার জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরদিনের মতো মূক হয়ে গেলেন।

নজরুলের মাত্র ১৪টি অভিভাষণের সন্ধান আমরা পাই। যার অধিকাংশ কবি দিয়েছেন তাঁর অসুস্থ হওয়ার ৩-৪ বছরের মধ্যে। কবি উপলব্ধি করেছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্থান-পতনময় রাজনীতির ডামাডোলে হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধে অনৈক্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি সমাজ-সভ্যতার সংলগ্নতা থেকে দূর পরবাসে নিমজ্জিত, যেখান থেকে এ জাতির মুক্তির একমাত্র উপায় ছিল উদার মানবিকতার জয়গানের ভিতরে। আর সে কাজটিই করতে গিয়ে কবি নিজে হলেন অপরাধী। নিজ সমাজ হতে বিচ্যুত, হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অচ্ছুৎ। আর পরাধীন ভারতবর্ষের শাসক ব্রিটিশরাজের কাছে ছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহী, বিদ্রোহী। কবি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তাঁর সংবর্ধনার উত্তরে নিজেই ঘোষণা করেছেন নিজের পরিচয়- ‘বিংশ-শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরি অভিযান-সেনাদলের তূর্য-বাদকের একজন আমি— এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’

 

কাজী নজরুল ইসলামের এই সকল অভিভাষণে তৎকালীন ভারতবর্ষের আদিরূপটি সে সময়ের সমাজ-সভ্যতা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রকৃত পটভূমির ভিতরে তার জনমানুষের জীবনব্যবস্থাকে প্রকারান্তরে তুলে ধরেছে। কাজী নজরুলের এ এক অপূর্ব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিকতার ফসল, বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সংযোজন।

লেখক : কবি, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads