• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বাংলাদেশ কোন পথে?

রাজনৈতিক দল দিয়ে কি উন্নত চরিত্রের রাজনীতি সম্ভব?

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

বাংলাদেশ কোন পথে?

  • প্রকাশিত ২৬ মে ২০১৮

আমার মনে হয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ খুব একটা বড় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলছে। রাষ্ট্রটি নিঃরাজনীতিকৃত হয়ে আসছে ১৯৮০’র দশকের প্রায় শুরু থেকে। নিঃরাজনীতিকরণের কার্যক্রম কারা কীভাবে চালাচ্ছে তা নিয়ে কোনো চিন্তা গোটা জাতির মধ্যে নেই। রাজনীতির জায়গায় আছে দলাদলি, নগ্ন ক্ষমতার লড়াই, বাক-স্বাধীনতার দাবি আর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের তৎপরতা। রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো চিন্তা ও চেষ্টা নেই।

ক্ষমতালিপ্সু তৎপরতার মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের জন্য প্রকৃত ভালো কিছু করার প্রবণতা ও চিন্তা দুর্লভ। যে-নেতৃত্বের দ্বারা শুধুই ক্ষমতা উপভোগের জন্য ক্ষমতার লড়াই চলে সে-নেতৃত্বের দ্বারা রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। বাক-স্বাধীনতার দাবি তোলা হচ্ছে, মুক্তবুদ্ধি চর্চার কথা প্রচার করা হচ্ছে; কিন্তু রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের জন্য প্রকৃত ভালো, প্রগতিশীল কোনো প্রবণতা বা চিন্তার সন্ধান পাওয়া যায় না। গণতন্ত্রবিরোধী সব কার্যকলাপ গণতন্ত্রের নামে চালানো হচ্ছে। নানা কৌশলে কেবল ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে, ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালানোর মধ্যে স্বাধীন চিন্তাশীলতার কিংবা প্রগ্রতিশীলতার কোনো পরিচয় নেই। সাম্রাজ্যবাদী মহলের প্ররোচনা ও পরিচালনায় মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার- ইত্যাদি দ্বারা কী অর্জিত হয়েছে? কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের তৎপরতাকেই বলা হচ্ছে গণতন্ত্র। এটাকে ‘গণতন্ত্র’ না বলে ‘নির্বাচনতন্ত্র’ বলা সমীচীন। বাংলাদেশে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের সামর্থ্যও অর্জন করেনি। সেই ১৯৮০’র দশকের প্রায় শুরু থেকে ছক বাঁধা কিছু কথার মধ্যে রাজনীতি আবদ্ধ হয়ে আছে। সমাজে ও রাজনৈতিক মহলে গণতন্ত্রের ও সমাজতন্ত্রের ধারণা হারিয়ে গেছে, আর পরিত্যক্ত পুরাতন সব সংস্কার-বিশ্বাসের ও ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। চলমান গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতি লোকের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে বলেই এমনটি ঘটেছে। ১৯৮০’র দশকের শুরু থেকেই পলিটিক্যাল সোসাইটিকে যথাসম্ভব দুর্বল করা আর সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলোকে যথাসম্ভব প্রবল করার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়েই ঘটে চলছে নিঃরাজনীতিকরণের বা depoliticization-এর প্রক্রিয়া। রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার বা ripoliticization-এর কোনো প্রবণতা, কোনো চিন্তা, কোনো চেষ্টা খুঁজে পাওয়া যায় না। শাসক শ্রেণির লোকেরা (সরকারি ও সরকারবিরোধী উভয়পক্ষের) প্রাইভেট আলাপে বলে থাকেন যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ viable নয়। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলছেন। তারা দেশের রাজনীতিকে করে তুলেছেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কের অভিমুখী। সমাজের স্তরে স্তরে জুলুম-জবরদস্তি, শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা, দুর্নীতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ যেভাবে চলছে, জনজীবনে তার ফল কী হবে? হীনস্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসগুলোর কূটনীতিকদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে টেনে আনেন। ঢাকায় কয়েকটি দূতাবাসের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী পরিচালনা করার জন্য প্রতি মঙ্গলবারে বৈঠকে বসতেন। কূটনীতিকদের ওই গ্রুপের পরিচিতি ছিল Tuesday Group বলে। হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছিল ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ (failed state) বলে। সমাজের স্তরে স্তরে বিরাজ করছে হিংসা-প্রতিহিংসা। বাংলাদেশের প্রধান দুই দল জনগণের ওপর ভরসা রাখে না। এসব লক্ষ করেই বলছি- রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ খুব একটা বড় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলছে।

রাজনীতিতে যে নেতৃত্ব চলছে তাতে রাজনীতির ক্রমিক উন্নতির কোনো লক্ষণ কি খুঁজে পাওয়া যায়? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কি ভেতর থেকে দলীয় চরিত্র উন্নত করছে? রাজনৈতিক দল দিয়ে কি উন্নত চরিত্রের রাজনীতি সম্ভব? সিপিবি, বাসদ, জনসংহতি প্রভৃতি দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি কি উন্নত হবে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভীষণভাবে সক্রিয় আছে এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলো। নাগরিক কমিটির পর নাগরিক কমিটি সামনে আসছে, নাগরিক ঐক্য, নাগরিক সংহতি, নাগরিক আন্দোলন ইত্যাদি দ্বারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি আছে ইলেকশন ওয়াচ, ডেমোক্র্যাসি ওয়াচ, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা), পার্লামেন্ট ওয়াচ, ইলেকশন কমিশন ওয়াচ, এডুকেশন ওয়াচ, মাইনোরিটি ওয়াচ, সিপিডি, সুজন ইত্যাদি সংগঠনের সক্রিয়তা। এসব সংগঠন সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন (সিএসও) বলে পরিচিত। ১৯৮০’র দশকের প্রায় শুরু থেকে এসবের দ্বারাই নির্ধারিত হচ্ছে রাজনীতির ও রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি।

সমাজের উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন- সব স্তরেই মানুষের কেন্দ্রীয় প্রবণতা (central motive) ধনতান্ত্রিক। অধিক থেকে অধিক সম্পত্তির ও ক্ষমতার মালিক হওয়ার তাড়না দ্বারা মানুষ পরিচালিত হচ্ছে। উচ্চ ও উচ্চ মধ্যশ্রেণির লোকেরা চলছে ভোগবাদী নীতি নিয়ে। রাজনীতি ধনতন্ত্র, ক্ষমতাতন্ত্র ও ভোগতন্ত্রের অনুসারী। বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারভিত্তিক নেতৃত্ব আর পরিবারতন্ত্র চলছে গণতন্ত্রের নামে। অর্থনীতিবিদরা এবং ক্ষমতাসীন লোকেরা উন্নয়নের মহিমা কীর্তন করছেন। তাদের উন্নয়নের হিসাব সম্পূর্ণ বিশ্বব্যাংক অনুসারী। তাতে সবকিছু বিচার করা হয় ডলার ও টাকা দিয়ে, ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা নেই, অসাম্যবৃদ্ধি রোধ করার চিন্তা নেই, অসামাজিক কার্যকলাপ ও অপরাধ বেড়ে যাওয়া নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই।

সামনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণকে হুজুগে মাতানোর চেষ্টা চলছে। বাঙালিকে বলা হতো হুজুগে বাঙালি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালির সে বদনাম কেটে গিয়েছিল। পরে অবস্থা বদলে যায়। ১৯৮০’র দশক থেকে বাংলাদেশে গণআন্দোলনের নামে গণঅভ্যুত্থানের নামে, গণজাগরণের নামে যেসব কাণ্ডকারখানা চালানো হচ্ছে, আমার মনে হয়েছে সেগুলো মূলত হুজুগ। হীন স্বার্থান্বেষী মহল, কায়েমি স্বার্থবাদী মহল হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য প্রচারমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে জনসাধারণকে আন্দোলনে মাতিয়েছে। হুজুগ থেকে গণজাগরণ ভিন্ন। গণজাগরণে জনগণের মধ্যকার মহৎ মানবিক গুণাবলির জাগরণ ঘটে, মহান লক্ষ্য থাকে, মহান নেতৃত্ব থাকে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নতি করে চলছে। কৃষক-শ্রমিকদের শ্রমশক্তি আর উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে উৎপাদন বাড়ছে। পোশাক-শ্রমিকরা আয় করছে, বিদেশে গিয়ে শ্রমিকরা আয় করছে, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিয়ে সৈনিকরা আয় করছে। এসবই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণ। উন্নয়নের এই হিসাব বিশ্বব্যাংকের এবং বিশ্বব্যাংক অনুসারী অর্থনীতিবিদদের। এতে মানবিক বিষয়াদির বিবেচনা নেই। যদি মানবিক বিষয়াদি বিবেচনা করা হয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়, তা হলে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা যাবে যে, সারা দেশে সব মানুষই সম্মানজনক জীবন-যাপন করতে পারবে।

উন্নত অবস্থার দিকে চলতে হলে উন্নত নেতৃত্ব লাগবে, উন্নত রাজনীতি লাগবে।

যে রাজনীতি এখন বাংলাদেশে চলছে তাতে সাংবিধানিক উপায়ে রাজনীতির উন্নতি সাধন করা না হলে কয়েক বছরের মধ্যেই অসাংবিধানিক প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আমরা সাংবিধানিক উপায়ে উন্নতির দিকে যাত্রা চাই। সিএসও ও এনজিও মহল থেকে কথিত স্বেচ্ছামূলক যেসব প্রচারকার্য ও আন্দোলন চালানো হচ্ছে তা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সুস্থ রাজনীতির অনুকূল নয়, প্রতিকূল।

রাজনীতির সুস্থতা ও স্বাভাবিকতায় উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে রাজনৈতিক দল গঠনে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবি, বাসদ প্রভৃতি দল চাইলে ভেতর থেকে পুনর্গঠিত হয়ে উন্নততর দল হয়ে উঠতে পারে। নতুন দল গঠনেরও সুযোগ আছে। উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল দরকার। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি আদর্শের ভিত্তিতে সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে তুলতে হবে সর্বজনীন গণতন্ত্রের, জনগণের গণতন্ত্রের, শতভাগ মানুষের গণতন্ত্রের আদর্শ। এর জন্য রাজনৈতিক দলের ভেতরে রাজনৈতিক আদর্শের অধ্যয়ন ও অনুশীলন করতে হবে। দলকে চলতে হবে জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে। জনসম্পৃক্তি ছাড়া, জনগণের জাগ্রত সক্রিয়তা ছাড়া প্রকৃত রাজনৈতিক দল হবে না।

বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্যও চিন্তা এবং চেষ্টা লাগবে। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তিতে নতুন বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ তৈরি করে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘকে রূপান্তরিত করা যেতে পারে নতুন বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষে। তা সম্ভব না হলে নতুন বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে হবে।

সহজে কিছু হয়ে যাবে না, সাধনা ও সংগ্রাম লাগবে, দূরদর্শিতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা লাগবে। প্রথমে দরকার অভীষ্ট স্বতন্ত্র চিন্তাধারা। তারপর গড়ে তুলতে হবে স্বতন্ত্র কর্মধারা। এ বিষয়ে আমার অনুসন্ধানের, চিন্তার ও মতের প্রকাশ আছে আমার রচিত ‘জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বায়ন ও ভবিষ্যৎ’, ‘নৈতিক চেতনা ধর্ম ও আদর্শ’ এবং ‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে। এ বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা, মতবিনিময়, কর্মসূচি ও কার্যক্রম দরকার। বাংলাদেশে যত তাড়াতাড়ি সে ধারার চিন্তা ও কার্যক্রম সূচিত হয়, আমাদের রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের জন্য তত মঙ্গল।

 

আবুল কাসেম ফজলুল হক

চিন্তাবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads