• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাই শেষ কথা

১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাই শেষ কথা

  • আমিরুল মোমেনীন
  • প্রকাশিত ২৯ মে ২০১৮

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শুরুর দিকের নেতাদের মধ্যে এখনো জীবিত আছেন সাবেক মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ। শিক্ষা সনদ অনুযায়ী তার বয়স ৯২ বছর অতিক্রম করেছে। আট বছর আগেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন গুলশানের এক হাসপাতালে। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না দেখে চিকিৎসকরা একদিন লাইফ সাপোর্ট ছিন্ন করে দেন। ঠিক সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত হন আজিজ সাহেবের ছোট মেয়ে ডাক্তার নাবিল শেখ। পেশায় চিকিৎসক নাবিল একজন শিশু হূদরোগ বিশেষজ্ঞ। ‘হার্টবিট’ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই তার বাবার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হয়েছে জানতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি। সেই সঙ্গে দ্রুত লাইফ সাপোর্টটি আবার চালু করান। এর কয়েক দিন পর আজিজ সাহেব জ্ঞান ফিরে পান। এরপর তিনি খুব বেশিদিন হাসপাতালে ছিলেন না। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। এখনো তিনি জীবিত আছেন। কিন্তু সেদিন যদি তার চিকিৎসক-কন্যা ওই সময়ে হাসপাতালে না যেতেন তাহলে এ জীবনে তার বাসায় ফেরা হতো না। তাই বলা যায়, সন্দেহের অবকাশ রেখে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আবার অতিমাত্রায় সাবধানী হয়ে অন্যের বিরক্তি বা ক্ষতির কারণ কিংবা নিজেকে হাস্যাস্পদ বস্তুতে পরিণত করাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে একটি গল্প এখানে উল্লেখ করা যুৎসই মনে করছি। গল্পটি বন্ধুবর সিনিয়র সাংবাদিক আবু তাহেরের কাছ থেকে শোনা। গল্পটি এ রকম— ঢাকা থেকে প্রকাশিত এক পত্রিকার কোনো এক উপজেলা প্রতিনিধি থানায় ফোন করে ওসি সাহেবের কাছে জানতে চান, ‘আচ্ছা ওসি সাহেব কিছুক্ষণ আগে আমি থানার বারান্দায় যে লাশটা দেখে এলাম, সেটা যে ডেডবডি তা আপনি কনফার্ম করেন কি-না?’

ওসি : হাঁ, লোকটাকে মৃত অবস্থায় থানায় আনা হয়েছিল। এখান থেকে হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে ডেডবডির ময়নাতদন্তের জন্য।

সাংবাদিক : ‘না, আপনি সিওর হয়ে বলেন। রিপোর্টটা কিন্তু আমি হেড অফিসে পাঠাব।’ এই ‘সিওর’ হওয়াকে নির্বোধ সতর্কতা বলা যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, যে ডেডবডির ময়নাতদন্ত হচ্ছে সে লাশ না জীবিত, এমন প্রশ্ন কেবল অন্যের হাসির খোরাক জোগাবে।

এই গ্রন্থনার মূল কারণ সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণার পর সৃষ্ট বিভ্রান্তি। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা ৩০, জেলা ১০, নারী ১০ এবং উপজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোটা ৫৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ১০ ভাগ করার দাবি জানান।

কোটা প্রবর্তন করা হয় স্বাধীনতার পর পরই অনগ্রসর শ্রেণিকে সুবিধা প্রদানের জন্য। কিন্তু একের পর এক কোটা নির্ধারণের ফলে মোট কোটার পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ৫৫ ভাগেরও বেশি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত ৩৬ শতাংশ। কিন্তু তারা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২.৬৩ শতাংশ। এরপর জেলা এবং নারী কোটা আছে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি চাকরির অর্ধেকেরও বেশি কোটার দখলে, মেধার দখলে অর্ধেকেরও কম শতকরা ৪৫ ভাগ। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। তাদের দাবির যথার্থতা রয়েছে, তার চেয়ে বড় কথা তারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত একটা ফয়সালার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেন। এরপর গত ৯ এপ্রিল সোমবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সরকারের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠক করে। সেই বৈঠকে জানানো হয়, সরকার এক মাসের মধ্যে (৭ মে) পরীক্ষানিরীক্ষা করে কোটা সংস্কারের ব্যবস্থা নেবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার আন্দোলন পরিষদের নেতারা আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন। কিন্তু সোমবার রাতেই কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারের আলোচনায় কোটা সংস্কার নিয়ে বলেন, ‘পরিষ্কার বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ চলছে, চলবে। রাজাকারের বাচ্চাদের আমরা দেখে নেব। তবে ছাত্রদের প্রতি আমাদের কোনো রাগ নেই। মতলববাজ, জামায়াত-শিবির, তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে সামান্য শৈথিল্য দেখানো হবে না।’

পরদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা অবশ্যই থাকবে, তবে এটি সংস্কার করা উচিত। কোটা সংস্কারের বিষয়টি আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। তারপরও আমি প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছি এটিকে সংস্কার করার জন্য। বাজেটের পর ৫৬ শতাংশর কোটা অবশ্যই সংস্কার করা হবে। কারণ, কোটায় প্রার্থী পাওয়া যায় না।’

প্রধানত এই দুই মন্ত্রীর বক্তব্য কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হন। তারা এক মাসের সময় নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন এবং সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। পরদিন সকালে মতিয়া চৌধুরীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যাও আশা করেন তারা।

বেঁধে দেওয়া সময়ে কোনো জবাব না পেয়ে আবার ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নেমে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এবার তারা কোটা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা রোদ-বৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, প্রধানমন্ত্রী এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই আর কোনো বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে গত ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তিনি সরাসরি ঘোষণা দেন, ‘কোটাই থাকবে না।’ অনেকটা অভিমানী কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোটা থাকলেই সংস্কারের প্রশ্ন আসবে। এখন সংস্কার করলে আগামীতে আরেক দল আবারো সংস্কারের কথা বলবে। থাকলেই ঝামেলা, তাই কোনো কোটারই দরকার নেই, কোটা ব্যবস্থা বাদ।’ এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, ‘রোদের মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় বসে আছে। সবারই তো অসুখ-বিসুখ হবে। তারপর আবার রাস্তা বন্ধ করে রাখছে। তীব্র যানজটে রোগীরা হাসপাতালে যেতে পারছে না।’ এভাবে কোটা বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিলেও প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যাতে অধিকার বঞ্চিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেবেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর স্বাভাবিক নিয়মেই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির মৃত্যু ঘটে। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহিত রাজনীতিক এবং আমলা অজ্ঞতাবশত প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। নানাজনে নানা মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন। কোনো কোনো আমলা বলছেন, ‘এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।’ এদের নির্বোধ বললেও কম বলা হবে। মহান জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর নতুন করে আর কী নির্দেশনা দিতে হবে? প্রয়োজনবোধ করলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সার-সংক্ষেপ পাঠান। এ ব্যাপারে তার কাছে লিখিত নির্দেশনা চাওয়ার ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আন্দোলনকারীদেরও সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। তাদের বোঝা উচিত, সরকারপ্রধান প্রকাশ্যে যে ঘোষণা দেন তা একপ্রকার আইন। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের তাদের গড়িমসি থাকতে পারে, কিন্তু এই ঘোষণা রদ করার ক্ষমতা কারো নেই।

বিস্ময়কর হচ্ছে, এত কিছুর পরও কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা হবে না-কি বাতিল হবে- সে বিষয়ে এখনো কিছু জানে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আসার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেলেই কোটা সংক্রান্ত গেজেট জারি করা হবে।

বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে কোটার উল্লেখ থাকছে। গত ৯ মে পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। এই বিজ্ঞপ্তির তথ্য ছকের ১৪ নম্বরে জানতে চাওয়া হয়েছে- প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনি কি-না? অপরদিকে ১৫ নম্বরে জানতে চাওয়া হয়েছে— প্রার্থী উপজাতীয় তফসিলভুক্ত কি-না? অর্থাৎ কোটার অবস্থান থেকে তারা সরে আসেনি। এ ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রায় প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ নিয়োগ কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে আমলে নিচ্ছে না। অথচ জনপ্রশাসন সচিব গত ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন প্রশ্নে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাড়াহুড়ার কিছু নেই। এখনই নতুন কোনো নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।’ এসব পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত ও কথাবার্তা জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে কার কী বক্তব্য তা জানা নেই, তবে এটা বলা যেতে পারে- এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে কেউ আদালতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে।

বিষয়টি অবশ্য খোলাসা করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ১৩ মে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই ফাইনাল। সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা পদ্ধতি থাকবে না।’ সরকারি চাকরিতে কোটা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখুন। প্রজ্ঞাপন জারির প্রক্রিয়া থেমে নেই। সময়মতোই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads