• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে চীনের কৌশলগত বিজয়

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জন উন

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে চীনের কৌশলগত বিজয়

  • প্রকাশিত ২৯ মে ২০১৮

বিল এমট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আকস্মিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিম জন উনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত ১২ জুনের বৈঠক বাতিল করা হয়। ট্রাম্পের এই প্রত্যাখ্যান উত্তর কোরীয় নেতাকে কূটনৈতিক বিপ্লব এনে দিয়েছে। আর চীনের জন্য এই সিদ্ধান্ত বড় ধরনের বিজয়ের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘শান্তির জন্য হুমকি’খ্যাত কিমের প্রতিচ্ছবিও মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বদলে গেছে।

সুবিশাল সাফল্যের স্বপ্নটা ছিল কিমের জন্য প্রায় অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার হুমকির মুখে এবং সুকঠিন অর্থনৈতিক অবরোধের বেড়াজালে সেটা সম্ভবও নয়। এমনকি প্রতিবেশী মিত্র চীনও অবরোধের পক্ষে। নানা প্রতিকূল অবস্থার ভিতর দিয়ে উত্তর কোরিয়া শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করে। বৈঠক বাতিলের প্রেক্ষাপটে কিম এখন নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিমই প্রথম ঐতিহাসিক এই দ্বিপক্ষীয় সংলাপের আহ্বান তুলেছেন— এখন অবশ্য তার প্রস্তাব ভেস্তে গেছে। অথচ ট্রাম্পই এই প্রস্তাব প্রথম গ্রহণ করেছিলেন— আবার তিনিই সেটা বাতিল করলেন।

কিম যে নিজেকে পরিবর্তন করেছেন তার নিশ্চয়তা দেওয়া এত সহজ নয়। এখন পর্যন্ত তিনি একজন নির্মম স্বৈরশাসক। আঞ্চলিক শান্তি বিঘ্নিত করতে কিম এক আতঙ্কের নাম। কিন্তু তারপরও উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে এই আলোচনার প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে। অন্তত উত্তর কোরিয়ার প্রতিশ্রুতিকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছে। 

সংলাপের বিষয়টা আলোচনার টেবিলে প্রথম যখন ওঠে, কিম তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে উত্তর কোরিয়া পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ করবে। বিষয়টা ধোঁয়াশার মতো মনে হলেও আশার পথ খুলে দিয়েছিল। কেননা অনেক জোরাজুরি, প্রতিবন্ধকতার পরেও কিম পরমাণু কর্মসূচি থেকে সরে আসেনি। সামরিক উত্তেজনা পরিহারের লক্ষ্যে একটি সমঝোতার ছকে উত্তর কোরিয়াকে বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্প-কিম বৈঠক ফলপ্রসূ হতে পারত। অন্ততপক্ষে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন এই আলোচনা প্রস্তুতিকে স্বাগত জানিয়েছিল।

আলোচনার জন্য আমেরিকার অবস্থান যে স্পষ্ট ছিল— সেটাও বলা যায় না। ট্রাম্প প্রশাসন মুখিয়ে ছিল উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ধ্বংস করার পক্ষে। বিষয়টা ভবিতব্য আলোচনা অনুষ্ঠানকে জটিল করে তুলছিল। অন্যদিকে ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা আরো বাড়তে থাকে। তা ছাড়া দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের অসংলগ্ন বক্তব্যে (উত্তর কোরিয়ার অবস্থা হবে গাদ্দাফির সময়ের লিবিয়ার মতো) সম্ভাবনার আলোচনা ভেস্তে যায়। এটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল যে, এসব উক্তির ফলে কিমও চটে বসবেন। বাস্তবেও সেটাই হলো। ট্রাম্পের বৈঠক বাতিলের পত্র ‘ক্রোধ আর প্রকাশ্য শত্রুতার’ পথকে আবারো খোলাসা করে দিল। হয়তো কিমের কাছ থেকে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল! কিন্তু আমেরিকান হুমকি-ধামকি উত্তর কোরিয়ানদের দমাতে পারবে বলে মনে হয় না।

ট্রাম্পের পরিকল্পনায় পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ছিল নাকি আরো কোনো কঠিন পদক্ষেপ— এই প্রশ্নটাই এখন বার বার ফিরে আসছে। বৈঠক বাতিলের আড়ালে ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর কোরীয় সাম্রাজ্যে আঘাত হানতে চেয়েছিল কি না সে প্রশ্নও উঠে আসছে। পরবর্তী পদক্ষেপ এখন নির্ভর করছে কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপানের প্রতিক্রিয়ার ওপর। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখন নিরপেক্ষ তথা বাফার জোনে অবস্থান করছে। তারা ট্রাম্পের অবিবেচক সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জাপান অবশ্য ইতোমধ্যে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাপানের স্টিলমেকারদের ওপর থেকে করারোপের হুমকি প্রত্যাহারের পরও ট্রাম্প প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো সুবিধা আদায় করতে পারেনি।

বৈঠক বাতিলের পরিণতি কী হবে? ট্রাম্পের বৈঠক বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় উত্তর কোরিয়া কী করবে? অবশ্য উত্তর কোরিয়া আত্মসংবরণ করে আলোচনার পথ খোলা রেখেছে। দ্বিধা ভুলে ট্রাম্প আবার আলোচনায় বসবেন কি? সে যাই হোক— মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিষয়ে চীন কীভাবে সাড়া দেবে। গত বছর উত্তর কোরিয়ার ক্লায়েন্টের ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনও সম্মত ছিল। এটি প্রমাণ করে যে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ব্যাপারে চীনের সদিচ্ছা রয়েছে। অতি সম্প্রতি দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে চীন কিমকে আবারো অতিথি হিসেবে বরণ করেছে। উত্তর কোরীয় নেতা হিসেবে এটা ছিল কিমের প্রথম বিদেশ সফর। কিম যে শি জিন পিংয়ের প্রতি অনুগত এবং তার কূটনৈতিক সমর্থন চান— কিমের চীন সফরে সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ট্রাম্প যেহেতু বৈঠক বাতিল করেছেন, তাই উত্তর কোরিয়াকে দায়ী করার জন্য চীন তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাবে না। তবে ট্রাম্প চীনকে দ্বিমুখী পছন্দের একটি ফ্রেম বেঁধে দিয়েছে— হয় চীন বাণিজ্য অবরোধের বিষয়ে একমত হবে; নয় তো উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে কিমকে মনে করিয়ে দেবে যে কিম সম্পূর্ণরূপে চীনের ওপর নির্ভরশীল। তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপান উভয়ই ট্রাম্প প্রশাসনের হিংসাত্মক বাণিজ্য অবরোধের কারণে ক্ষুব্ধ। তাই উত্তর কোরিয়া ও ইরান পরমাণু কর্মসূচি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া শর্ত পূরণের ব্যাপারে চীনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ দেওয়ার যথেষ্ট কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে— আপাতত এটাই এখন চীনের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ।

কোরীয় উপদ্বীপে যেকোনো ধরনের সামরিক আগ্রাসন কৌশলগতভাবে চীনের বিজয়কেই ত্বরান্বিত করবে। উপরন্তু করদ মিত্র হিসেবে চীন দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অনুঘটকের কাজ করতে পারে। এখন এই অঞ্চলে যেটাই ঘটুক না কেন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সব দিক থেকে চীনই এগিয়ে থাকবে। মার্কিন প্রভাব খর্ব হওয়া মানে কৌশলগত শক্তির দিক থেকে চীনকে এগিয়ে রাখা। আর এটাই হয়েছে— চীনা আধিপত্য এখন অপ্রতিরোধ্য। ট্রাম্পকে ধন্যবাদ! কেননা চীনা আধিপত্যের সেই প্রক্রিয়া তিনিই খোলাসা করে দিয়েছেন।

লেখক : দ্য ইকোনমিস্টের সাবেক প্রধান সম্পাদক

অনুবাদ : মো. রাশিদুল ইসলাম

স্বত্ব :  প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads