• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি

দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণেই পোশাক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে

আর্ট : রাকিব

মতামত

বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ৩১ মে ২০১৮

আমরা মানুষ। সামাজিক জীব। সামাজিক বলেই, জীবনাচরণের কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসামাজিকতার প্রশ্ন তৈরি হয়। মতের বৈপরীত্য, ভালো লাগা না-লাগার নানান দিক নিয়েই হেঁটে চলেছি কাল থেকে কালান্তরে। একটা বয়সে এসে সবারই এই হাঁটা থেমে যায়। থেকে যায় মানুষের কীর্তি, তার কৃষ্টি এবং জীবনবোধের ধারাবাহিকতা। আমরা কেউই এই নিয়মের বাইরে নই। পৃথিবীর সব দেশের মানুষেরই নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব পোশাক ও রীতিনীতি। পোশাক কেবল ব্যক্তির শরীর ঢাকার জন্যই নয়, একান্ত ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়ও এটি নয়। বরং পোশাক একটি জাতির বিশিষ্টতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি তথা সামগ্রিক পরিচয় প্রকাশ করে।

কোনো কোনো দেশে পোশাকের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে পোশাকের ডিজাইনে শালীন এবং অশালীন রীতিনীতির ধারণা কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব অনস্বীকার্য। মুসলিম বিশ্বে পোশাকে শালীন-অশালীনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। পর্দাপ্রথার সঙ্গে মিল রেখে বিশেষ করে মুসলিম নারীদের পোশাক নির্বাচন করা হয়। তবে সব পরিবারে বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্ব পায় না। পোশাকের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক কৃষ্টি-কালচারেরও রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। শ্লীল এবং অশ্লীলের ধারণার মধ্যেও অঞ্চলভেদে ব্যবধান রয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শালীনতাবোধের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। পশ্চিমে যা শালীন, প্রাচ্যে তা শালীন বলে বিবেচিত নাও হতে পারে। আবার আমাদের এই উপমহাদেশের অঞ্চলভেদে ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও শালীনতা ও সৌজন্যবোধের রূপ প্রায় একই। বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা ঐকতান রয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শালীনতার বোধটি বহন করতে হয় সবচেয়ে বেশি মেয়েদের। এই মানসিকতা থেকে নারীই যেনবা শোভন-অশোভনের মাপকাঠি।

কোনো নারী স্বল্পবসনা। আবার মেয়েদের কেউ কেউ পর্দার নামে নিজেকে আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত করে রাখেন। আবার অনেক নারী স্বাভাবিক পোশাকেই শালীনতা বজায় রেখে চলেন। দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রথাগত রীতির কারণেই আমরা স্বল্পবসনাকে অশালীন, রগরগে, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন বলে নিন্দা করে থাকি। আবার যেসব দেশে প্রথাগতভাবেই স্বল্পবসনাকে স্বাভাবিক পোশাক বা তাদের দৃষ্টিতে শালীন বলে মনে হয়, সেসব পোশাককে মুসলিম বিশ্বে অশোভন বা অশালীন বলা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণেই আমাদের দেশে পোশাক নিয়ে শালীন আর অশালীনের প্রশ্ন ওঠে।

এখন বিশ্বায়নের যুগ। প্রযুক্তির উন্নতিতে পুরো পৃথিবীই সবার হাতের মুঠোয়। রাষ্ট্র ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, কৃষ্টি-সংস্কৃতিও ভিন্ন ভিন্ন্ন। তবু জীবনের নানান ছন্দে নান্দনিকতা উপভোগ করতে সব দেশেই উঠতি প্রজন্মের একটি অংশ নিজেদের ব্যতিক্রম বা ভিন্নভাবে প্রকাশ করতে চায়। আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মের একটি অংশ পোশাকে নিজেদের সেভাবেই প্রকাশ করছে। একে অনেকেই বলছেন বিজাতীয় সংস্কৃতি। পোশাকে এই পরিবর্তন উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী উভয়ের মধ্যে দেখা গেলেও আলোচনায় আসে শুধু নারীর নিত্যনতুন ডিজাইনের আঁটসাঁট পোশাকের বিষয়টি। রাস্তাঘাটে স্কিনটাইট (শরীরে লেগে থাকা) পোশাক পরা মেয়েদের দিকে অনেক পুরুষই কামুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ দাঁত কড়মড়িয়ে বলে থাকেন— দেখেছ, কী পরেছে! অসভ্য মেয়ে একটা!

পত্রিকার পাতা খুললেই আজকাল ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। ধর্ষণপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণ খুঁজে বের করতে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে নানাভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের কেউ কেউ এজন্য পোশাককেও দায়ী করেন এবং বলেন, উঠতি বয়সী মেয়েদের একটি অংশ পাতলা, মসৃণ ও শরীরে এঁটেসেঁটে থাকা নরম কাপড়ের পোশাক পরিধান করে। যে পোশাক দেহের ওপরের ত্বকের মতোই, ওসব পোশাক কোনোভাবেই দেহসৌষ্ঠব পরিমার্জিত করে না। যে কারণে বিপরীত লিঙ্গের খারাপ মানুষের কুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তারা আরো বলেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতেই উঠতি বয়সী মেয়েদের একটি অংশ প্রথাবিরোধী যৌন আবেদন সৃষ্টি হয় এমন পোশাক পরে থাকে। বিষয়টি অবশ্যই তর্কসাপেক্ষ। বছর কয়েক আগেও দেশে ধর্ষণপ্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের পোশাক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। প্রযুক্তির সুবাদে হাতের নাগালে পর্নো ছবি আর উদ্দীপক নানান কিছুর সমাহারে পোশাকের এই আলোচনাও চাপা পড়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশেক মাহমুদ শিমুল বললেন, দেশের সবকিছুতেই উন্নয়ন ঘটেছে। নারীর উন্নয়ন উল্লেখ করার মতো। তবে প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়নের মধ্য থেকে উঠতি প্রজন্ম কোনটি গ্রহণ করবে আর কোনটি বর্জন করবে, সে বিষয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো দিকনির্দেশনা নেই। প্রযুক্তির আশীর্বাদে পৃথিবীর নানান প্রান্তের নানান সংস্কৃতির সঙ্গে লঘু পরিচয়ের মধ্য দিয়ে  তাদের অনেকের মানসিক বৈকল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

এই শিক্ষক নিজেকে নিয়ে উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, স্বাভাবিক পোশাকে ক্লাসে গেলে ছাত্রছাত্রীরা বলেন, স্যার এখনো সেকেলেই রয়ে গেছেন।

একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, যতই দিন যাচ্ছে ততই নারীকে বিভিন্ন মিডিয়ায় পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কোনো নারীকে যখন স্বল্পবসনে টিভি স্ক্রিনে উপস্থাপন করা হয় তখন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মনে অসুস্থ আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সিনেমায় দর্শকের আকর্ষণ বাড়াতে নারীকে স্বল্পবসনে অর্ধনগ্ন অথবা চামড়ার মতো গায়ে লেগে থাকা কোনো কোনো পোশাকে নগ্ন করেই উপস্থাপন করা হয়। এসব পোশাকে উপস্থাপন করে নারীর সম্ভ্রমহানিই করা হচ্ছে।

ড. আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, নারীকে এমন পোশাকে দেখে কোনো কোনো পুরুষের মনে বিকৃত আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে সেসব পুরুষের বিকৃত চাহিদা পূরণ হয় না বলে সমাজে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে।

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মিজানুর রহমান বলেন, কিছু নারী উগ্র পোশাক পরছেন। যে পোশাকে তাদের মর্যাদা রক্ষা হয় না। পর্দারক্ষার জন্য বোরকাই যে পরতে হবে এমন তো নয়। সাধারণ পোশাকেও পর্দা বা শালীনতা বজায় রাখা যায়। তিনি বলেন, পোশাকি বেহায়াপনা এখন গ্রামগঞ্জেও ঢুকে গেছে। এর কারণ এসব পোশাকের নানামুখী বাণিজ্যিকীকরণ।

২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতে মেডিকেল ছাত্রী জ্যোতি সিং, যাকে ছদ্ম নামে নির্ভয়া বলা হয়েছিল, তাকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে নির্ভয়া মারা যান। নির্ভয়ার মা এই জঘন্য ঘটনার বিচার চেয়ে দোষীদের বিচার দাবি করেছিলেন। পাশাপাশি মেয়েদের পোশাকেও শালীনতা বজায় রাখার অনুরোধ করেন। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নির্ভয়ার মা এই মন্তব্য করেন। নারীর পোশাকের কারণে কোনো কোনো মানুষের যে বিকৃত আকাঙ্ক্ষা ফুঁসে ওঠে, সে বিষয়টি হয়তো নির্ভয়ার মা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই পোশাকের ব্যাপারে শালীন হওয়ার তার এই অনুরোধ।

ধর্ষণ বা ধর্ষণের মতো সামাজিক অনাচারের জন্য শুধু যে পোশাকই দায়ী নয়, সে কথা ঠিক। তবে এদেশের প্রথাবিরোধী পোশাক, যাকে বাঙালি সমাজ অশালীন বলে, সে পোশাক যে বিকৃত মানসিকতা উসকে দেয় না তা ঠিক নয়। কারণ আমাদের দেশের কিছু মানুষ নিজ ঘরে মা, খালা, বোনকে যেমন শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে। বাইরে এলে কারো কারো ক্ষেত্রে সে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় বিকৃত কামনায়। এজন্য নারীর পোশাকে শালীনতা প্রয়োজন, একইসঙ্গে প্রয়োজন বিপরীত লিঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। এই শিক্ষা নিতে হবে পরিবার থেকে। পরিবার পৃথিবীর আদিমতম সংগঠন। সেখান থেকেই ঘটে মানুষের বোধ-বুদ্ধি, রুচি ও মননের মূলভাবটির বিকাশ। তাই পরিবার থেকে শুরু করতে হবে কাজটি। এরপর সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ দেবে এসব নিয়ে দিকনির্দেশনা।

লেখক : সাংবাদিক

e mail- ofshamimbd@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads