• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
তিস্তা চুক্তি কতদূর-দুই

প্রায় ৩৫ বছর ধরে ঝুলে রয়েছে তিস্তা চুক্তি

সংগৃহীত ছবি

মতামত

তিস্তা চুক্তি কতদূর-দুই

  • আতাহার খান
  • প্রকাশিত ০১ জুন ২০১৮

তিস্তা সমস্যা সমাধানের একটি বিমূর্ত ইঙ্গিত পাওয়া গেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে। ২৬ মে তাজ বেঙ্গল হোটেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠক শেষে মমতা গণমাধ্যমকে জানান, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনা কোন পর্যন্ত গড়িয়েছে, তা নিয়ে তিনি মুখ খোলেননি। তবে আশার কথা, মমতা আগের মতো বলেননি বাংলাদেশকে পানি দেওয়া যাবে না। পরিষ্কার বলেছেন তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তার এই উক্তি থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, শুরু হয়ে গেছে বরফ গলা। বাংলাদেশের এই নির্বাচনের বছরেই মীমাংসার পথ খুঁজে পাবে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি।

আমরা দেখেছি ১৯৮৩ সাল থেকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলে আসছে। চুক্তি স্বাক্ষর হবে হবে করেও শেষঅবধি হয়নি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে ঝুলে রয়েছে তিস্তা চুক্তি। মাঝে ২০১১ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করতে পারেননি। এতে আশাহত হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। তারপরও সে সময় বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আমাদের আশাবাদী করে জোর গলায় বলেছিলেন, ‘তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হবেই।’ ২০১১ সালের পর এখন চলছে ২০১৮ সাল। মাঝে পার হয়ে গেছে সাতটি বছর। এতদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল, বাংলাদেশকে পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গে শুষ্কতা দেখা দেবে, কৃষিব্যবস্থাও পুরো ভেঙে পড়বে। এখন মনে হচ্ছে, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মমতা তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। হয়তো একটা মীমাংসায় আসবেন তিনি। এই অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ ও ২৬ মে ভারতে যান শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার একান্ত বৈঠক হয়।

এ কথা তো মানতেই হবে যে, এই বিশ্বায়নের যুগে কেউ একই সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী অবস্থান পাল্টাতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার অবস্থান পাল্টিয়েছেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন আন্তর্জাতিক নদীর ওপর উজানের দেশ কোনো প্রকল্প তৈরি করে ভাটির দেশের নদীনির্ভর পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতি করতে পারে না। সে সুযোগও এখন আর নেই। তিনি হয়তো এও জানেন যে, তিস্তা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ বাধ্য হয়েই কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি ফোরাম, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশন, রামসার কনভেনশন, ইন্টারন্যাশনাল ওয়েটল্যান্ড কনভেনশন ইত্যাদি ফোরামে যেতে পারে তিস্তার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক ফোরামগুলো আছে বলেই জার্মানি-হাঙ্গেরি, ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো এবং আফ্রিকার নীল নদ অববাহিকার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নদীর পানির হিস্যা নিয়ে স্থায়ী মীমাংসা।

আন্তর্জাতিক নদী আইন বুঝে পানির জন্য দরকষাকষিতে আমরা অসমর্থ, এ কথা তোলা অর্থহীন। কারণ এর আগে সমুদ্র আইন অনুযায়ী আমরা বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সীমানার ওপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। সেখানে ভারত ও মিয়ানমারের কিছু বলার ছিল না। অভিন্ন নদীর বেলায়ও আমরা অনুরূপ সুবিধা পেতে পারি— যদি আমরা ইসিই (ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ)-এর পক্ষরাষ্ট্র হতে পারি। অভিন্ন নদীর ওপর আমাদের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই কনভেনশন বড় ধরনের সহায়তা দিতে পারে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই কনভেনশনের সদস্য বা পক্ষরাষ্ট্র হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করা হয় ইউরোপের বাইরে যেকোনো দেশের জন্য। ইসিই ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক নদী ও হ্রদ সংক্রান্ত একটি কনভেনশন (চুক্তি) করেছিল। কনভেনশনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, আন্তর্জাতিক নদীর ওপর উজানের দেশ কোনো প্রকল্প তৈরি করে ভাটির দেশের নদীনির্ভর পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতি করতে পারবে না। এককভাবে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর কোনো দেশ কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে অন্য দেশের নদীনির্ভরশীল পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতি করতে পারে না। সে সুযোগও নেই। তা ছাড়া অববাহিকার সব দেশের মধ্যে অবাধ তথ্য বিনিময় ও আলোচনা এবং নদীর পানির মান ও পরিবেশ রক্ষার কথা গুরুত্বসহ উল্লেখ করা আছে। নদীর পানি ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও রক্ষার জন্য অববাহিকাভিত্তিক যৌথ কমিশন গঠন করে সব রাষ্ট্রের সমঝোতার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী আইনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের মাত্রা যোগ করেছে। যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা এই কনভেনশনের সহায়তা লাভ করতে পারি এবং সেক্ষেত্রে সমুদ্র বিজয়ের মতো অভিন্ন নদী তিস্তার পানির ওপর আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে অনেকটাই এগিয়ে থাকতে পারব।

আজ বাধ্য হয়েই বলতে হয়, এমন একটি অভিন্ন নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ক্ষুণ্ন করার জন্য সিকিম অংশে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয় বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। হিমালয়ের ৭ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে তিস্তা নদীর সৃষ্টি। এটি দার্জিলিংয়ে অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসঙ্করের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। দার্জিলিং পাহাড়ে তিস্তা একটি বন্য নদী হিসেবে পরিচিত এবং এর উপত্যকা ঘন বনে আচ্ছাদিত। পার্বত্য অঞ্চলে এর নিষ্পেষণ এলাকার পরিমাণ মাত্র ১২ হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সেবকের করোনেশন সেতু পেরিয়ে তিস্তা জলপাইগুড়ি জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয় ব্রহ্মপুত্র নদে।

তিস্তা নদী সব মিলিয়ে ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে পদ্মার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনো বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত। তিস্তার মাসিক গড় পানি অপসারণের পরিমাণ ২ হাজার ৪৩০ কিউসেক।

এই জীবন্ত স্বতঃস্ফূর্ত নদীর বুকে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায়। সেখানে বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার টুঁটি চেপে ধরে পুরো পানি সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র। গজলডোবা বাঁধের মোট গেটের সংখ্যা ৪৫টি। মাত্র দুটি গেট ছাড়া বাকি ৪৩ গেটের মাধ্যমে তিস্তার প্রায় পুরো পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই পানি মহানন্দার ভেতর দিয়ে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদহ, জলপাইগুড়িসহ বিভিন্ন জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি বিহারের মেচি নদী পর্যন্ত এই পানি নেওয়া হচ্ছে। তাই গজলডোবা বাঁধ থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত একমাত্র বন্যা মৌসুম ছাড়া তিস্তার পুরো নদীপথই থাকে পানিশূন্য। একটি নদীকে জোর করে মৃত্যুর মুখে এভাবে ঠেলে দিয়ে ভাটির দেশের ক্ষতি করার অধিকার উজানের দেশের নেই। বাস্তবে এ ধরনের একতরফা পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকায় মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে স্থবির।

জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ থেকে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব পানি দিবস। প্রতিবছরই পানি দিবস উপলক্ষে থাকে একটি প্রতিপাদ্য। ১৯৯৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘পানিসম্পদ সুরক্ষা সকলের দায়িত্ব’। ২০০৯ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অভিন্ন জল ও জলের ভাগ’। ২০১৮ সালের প্রতিপাদ্য হলো, ‘পানির জন্য প্রকৃতি’।

তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রতিপাদ্যের কোনোটিই উজানের দেশ মানেনি এবং বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাও দেখায়নি। অথচ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিটি দেশেরই ‘পানি আইন’ ও ‘জাতীয় পানি নীতি’ রয়েছে। বাংলাদেশেরও আছে। সেখানে পানিসম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে সুস্পষ্ট নীতিমালা। আছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নদী কমিশন। বরফ যখন গলা শুরু হয়ে গেছে, তখন একে নিশ্চয়ই আরো বেশি সক্রিয় করা যায়।

পাদটীকা

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর একটি ছবি এভাবে কল্পনা করা যেতে পারে। নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে একসময় একটি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম হয়ে ব্রহ্মপুত্রে এসে মেশে— সেই নদী এখন পুরো শুষ্ক। এর বুকে ধু ধু বালু, কোথাও কোথাও মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। এক ফোঁটা অশ্রু ছাড়া আর কোনো পানি নেই। কঙ্কালের মতো নদীর একটা ছাপ নিয়ে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে সাড়াশব্দহীন— তার ওপর দিয়ে বাতাসে রোদের দাহ বয়ে যাচ্ছে এলোমেলো। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর কল্পনার জাল বিছিয়ে ছবিটি এ পর্যন্তই আঁকা— নদীটির নাম তিস্তা।

ভবিষ্যতের কথা আগে থেকে বলা যায় না সত্য; কিন্তু কার্যকারণসূত্রে আগামী পঞ্চাশ বছর পর তিস্তার অবস্থা কেমন হবে তা বলে দেওয়া যায়। যদি তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হয়, তাহলে তিস্তা অববাহিকায় বসবাসরত তিন কোটি মানুষ ফিরে পাবে নতুন জীবন। আর যদি না হয়, তাহলে পঞ্চাশ বছর পর ক্লাসরুমে ভূগোলের শিক্ষক বাংলাদেশের ম্যাপ টাঙিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বলবেন, একসময় এখান দিয়ে অর্থাৎ নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে একটি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম হয়ে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিশেছিল— এটি ছিল তখন খরস্রোতা নদী। এখন নদীটির কোনো চিহ্ন নেই।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads